দীপাবলির শেষ মহড়া কাল, রবিবার। ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন উদ্যানে। ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেন্স। অধুনা মুম্বইয়ের 'বোম্বে জিমখানা গ্রাউন্ড' অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ইডেনই বর্তমানে ভারতের প্রাচীনতম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠ।
ইডেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়েছিল ৫-৮ জানুয়ারি, ১৯৩৪। ভারত বনাম ইংল্যান্ড। ফলাফল ড্র।এহেন ইডেনে ৬৬ হাজার দর্শক ঠাসা গ্যালারির কানফাটানো শব্দব্রহ্মের সামনে দীপাবলির ঠিক আগের রবিবারে রোহিত শর্মার ভারত ২০২৩ ওয়ান ডে বিশ্বকাপে এই মুহূর্তের ফর্মের বিচারে সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও সেই প্রতিপক্ষের চেয়েও বিধ্বংসী মেজাজে রয়েছে এ বারের বিশ্বকাপের ভারতীয় ক্রিকেট দল!
আচ্ছা, আবেগের রঙিন চশমা সরিয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবের চোখের জরিপে বলুন তো, তিরাশির বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন কপিলদেবের ভারত কিংবা ২০১১ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারতের থেকেও চলতি বিশ্বকাপে রোহিতের ভারতীয় দলে ক'জন খেলোয়াড় ঢুকতে পারতেন?
যদি বলি তিরাশির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল থেকে শুধুমাত্র কপিল এবং ২০১১-র বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল থেকে ধোনি, যুবরাজ সিংহ এবং অবশ্যই সচিন তেন্ডুলকর বাদে আর কেউ নন, তাহলে কি খুব অন্যায় হবে কথাটা?
বিরাট কোহলি নামটা ইচ্ছাকৃতভাবেই অনুচ্চারিত রয়েছে এক্ষেত্রে, কারণ তিনি তো বর্তমান ভারতীয় দলেরই ব্যাটিং-কান্ডারি! সচিন এই দলে হাসতে হাসতে শুভমান গিলের জায়গায় যে ওপেনার থাকতেন তা নিঃসন্দেহে। হার্দিক পান্ড্যর পরিবর্তে কপিলের ঢোকাটাও খুব স্বাভাবিক। যেমনটা উইকেটকিপারের জায়গায় কে.এল রাহুলের স্থানে ধোনি।
অধিনায়ক হিসেবে দেশকে ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টি দুটো বিশ্বকাপ দেওয়া ছাড়াও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বের এক নম্বর করার জন্য ধোনিই হয়তো ২০২৩ বিশ্বকাপ ভারতীয় দলকেও নেতৃত্ব দিতেন। আর টেনেটুনে রবীন্দ্র জাদেজার জায়গায় ভারতের দ্বিতীয়বার (২০১১) বিশ্বকাপ জয়ের 'ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট' যুবরাজ। ব্যা্স! এর বাইরে কে আসেন রোহিতের এই দলে? দুঃখিত, গাওস্কর-বিশ্বনাথ থেকে শুরু করে রবি শাস্ত্রী-মোহিন্দর অমরনাথ, হরভজন-কুম্বলে, জাহির খান.. কেউ নন!
সাতে সাত! এ বারের বিশ্বকাপে এখনও অবধি সাতটা ম্যাচ খেলে সাতটাতেই জিতে বসে আছে ভারত! হ্যাঁ, এর আগে এমন আশ্চর্য কান্ড বা তার চেয়েও বেশি করে দেখিয়েছিল ২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারত। তবে সেটা টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচেই ১৬৬ বল বাকি থাকতে ৯ উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার হাতে দুরমুশ হওয়ায় মুম্বইয়ে সচিনের বাড়ি কিংবা বেঙ্গালুরুতে রাহুল দ্রাবিড়ের বাড়িতে ক্ষিপ্ত ভারতীয় ক্রিকেটভক্তরা ভাল ছোঁড়ার ঘটনার পর! টানা ৮টা ম্যাচ পরপর জিতে ভারত সেবার ফাইনালে উঠেছিল। যদিও সেখানে ফের অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১২৫ রানে হার!
রবিবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারালে রোহিতের ভারত ২০ বছরের পুরনো সৌরভের দলের সেই রেকর্ডও ছুঁয়ে ফেলবে, এবং তার পরের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে যে ৯-০ করবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
এ রকম দৃষ্টান্ত বোধহয় আর একটাই আছে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে। ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অফ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ভারত ট্রফি জিতেছিল সব ক'টা ম্যাচ জিতে। পাঁচে পাঁচ!
শুধু তাই নয়, সুনীল গাওস্করের ভারত গোটা টুর্নামেন্টে বিপক্ষের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ৫০টা উইকেটের মধ্যে ৪৯টা দখল করেছিল। কেবল ফাইনালে পাকিস্তানের (৫০ ওভারে ১৭৬-৯) শেষ উইকেটটি পড়েনি। এমনকি সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড (২০৬ অল আউট) বাদে সেবার কোনও দল ভারতের বিরুদ্ধে দু'শো রান টপকাতে পারেনি।
ঠিক তেমনই বিধ্বংসী ভারতকে দেখাচ্ছে এখনও পর্যন্ত এ বারের বিশ্বকাপে। তার জন্য টুর্নামেন্টের প্রথম দেশ হিসেবে এর মধ্যেই সেমিফাইনালের টিকিট পেয়ে গিয়েছেন রোহিত শর্মারা। ইডেনে রবিবার ভারত হারলে ৭-০ জয়ের সরণিতে 'দাগ' পড়বে বটে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। বরঞ্চ দক্ষিণ আফ্রিকা কাল ইডেনে জিতলে এবারের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে জায়গা নিশ্চিত করে ফেলবে।
সেই ইডেনের দিকে চলুন, আবার একটু ফেরা যাক। ইডেনে গত ৮৯ বছরে ৪২টা টেস্ট ম্যাচ খেলা হওয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক ওয়ান ডে ম্যাচ হয়েছে ৩৩টা, টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক হয়েছে ১১টা। প্রথম ওয়ান ডে হয় ভারত-পাকিস্তানে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭। প্রথম টি-টোয়েন্টি ২৯ অক্টোবর, ২০১১। ভারত বনাম ইংল্যান্ড। তাৎপর্যের দুটোতেই পরাজিত দলের নাম ছিল ভারত!
আবার ইডেন তার ঐতিহ্যের সুবিচার করে ১৯৮৭ ওয়ান ডে বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, দুটোরই ফাইনাল আয়োজন করেছে। যথাক্রমে ওই দুই বছরের ৮ নভেম্বর এবং ৩ এপ্রিল। সাতাশির কাপ ফাইনালে ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংয়ের সেই আত্মঘাতী রিভার্স সুইপের খেসারত দিয়ে মাত্র ৭ রানে হেরে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করে দিয়েছিলেন ইংরেজরা।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আবার ম্যাচের শেষ ওভারের প্রথম চারটে বলেই ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসকে পরপর চারটে ওভার বাউন্ডারি মেরে ব্রেথওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
আবার ইডেনেই ১৯৮৯ সালের ১ নভেম্বর নেহরু কাপ ওয়ার্ল্ড সিরিজের ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ম্যাচের এক বল বাকি থাকতে ছক্কা হাঁকিয়ে নাটকীয়ভাবে হারিয়ে পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ওয়াসিম আক্রম!
এমনকী ওই টুর্নামেন্টেই ইডেনে ভারত বনাম পাকিস্তান মহারণ হয়েছিল সে বারের কালীপুজোর দিন- ২৮ অক্টোবর, ১৯৮৯। অথচ তাতে দীপাবলির উৎসবে কোনও রকমের দুশ্চিন্তার প্রভাব পড়েনি। দিব্যি ইডেনের বাইশ গজে ভারত-পাক লড়াই হয়েছিল আর পাশাপাশি দীপাবলির আতশবাজির খেল চলেছিল শহর কলকাতা জুড়ে!
ঠিক ঠিক গুনতিতে ১০০৯৮ দিন পরে ইডেনে ভারতের বিশ্বকাপ ম্যাচের পরিপ্রেক্ষিতে যা বোধহয় বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবাই যায় না। আজ্ঞে হ্যাঁ, ১৩ মার্চ, ১৯৯৬ ওয়ান ডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের পর আগামিকাল ৫ নভেম্বর, ২০২৩- ঠিক ১০০৯৮ দিন বাদে নন্দনকাননে আবার কোনও বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলতে নামছে ভারত!
ইডেনে ১০০৯৮ দিনের পুরনো ভারতের সেই বিশ্বকাপ ম্যাচের স্মৃতি অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আজও দুঃস্বপ্নের! শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেই কাপ সেমিফাইনালে ভারতের অতীব ভঙ্গুর ব্যাটিংয়ে ক্ষিপ্ত ইডেনের দেশপ্রেমী দর্শকদের মাঠে জলের বোতল নিক্ষেপের জেরে ম্যাচ শেষমেশ বাতিলই হয়ে গিয়েছিল! শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী ঘোষণা করে।
নিশ্চয়ই ১০০৯৮ দিন পর সেই মহাভুল আমরা আর করব না এবার ইডেনে। যদি বা দক্ষিণ আফ্রিকা কাল জেতেও তাহলেও নয়। তবে রোহিত শর্মার ভারতের এবারের বিশ্বকাপে বিধ্বংসী মেজাজের নিরিখে সেরকম নেতিবাচক কিছু ভাববেনই বা কেন মশাই? বরং চলুন, পরের রবিবারের দীপাবলির শেষ মহলা এই রবিবার ইডেনে হোক ভারতের ম্যাচ জেতার পরে আতশবাজির রোশনাইয়ে! এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।