বিরাট বাড়ি, সবুজ রেলিংওয়ালা লাল বারান্দা। দুই দালানের পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান। এবং ভীষণ নিঃসঙ্গ। সারা উঠোন জুড়ে ঢালাই লোহার গ্যাসবাতি। সেগুলো এখন আর সন্ধ্যা হলে জ্বলে না। পুরনো আমলের বাহারি সব বেঞ্চ ঢেকে থাকে ধুলোয়। কেমন যেন মনমরা। তবু বর্ষার মেঘ কেটে গিয়ে শরতের আলো বাড়িটার উপর পড়লেই কী করে যে পালটে যায় সব!খুশির হাওয়া ভেসে বেড়াতে থাকে গোটা বাড়িতে। চতুর্দিকের ধুলো ঝেড়ে গা ঝাড়া দেয় সব মালিন্য। আগমনীর রং লাগে বাড়ি জুড়ে জমে থাকা অন্ধকারে।
অথচ এই বাড়িটাই আগে সারা বছর থাকত খুশিতে জমজমাট। স্বর্ণব্যবসায়ী বৈষ্ণবদাস মল্লিকের টাকাপয়সা, প্রভাব-প্রতিপত্তি কোনওটাই কম ছিল না। দর্পনারায়ণ স্ট্রিটের এই বাড়িটা যখন তৈরি করছেন, তখনই এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন দেবীকে। অভয়া মূর্তিতে মা এসেছেন তাঁর কাছে। বড় শান্ত অথচ দীপ্তিময়ী সে মূর্তি। বাড়ির উঠোন আলো হয়ে রয়েছে দেবীর প্রভায়।
চমকে উঠে বসলেন বৈষ্ণবদাস।রাতেই ঠিক করলেন এ বাড়িতেই মাকে পুজো করা হবে। যেখান দুর্গাকে অধিষ্ঠিত দেখেছিলেন,পরের দিন সেখানেই নির্দেশ দিলেন ঠাকুরদালান গড়ার। মা নিজে এই বাড়িতে আসতে চান- এর থেকে বেশি সৌভাগ্যের আর কী হতে পারে! সেই শরতেই দেবীর পুজো শুরু করবেন বলে মনস্থ করলেন তিনি। যে মূর্তিতে দেবী এসেছিলেন স্বপ্নে, হুবহু সেই রূপেই মাকে গড়ার নির্দেশ দেওয়া হলকুমোরদের। দেবীমূর্তি তৈরির কাজ শেষ হল। বৈষ্ণবদাস অবাক হয়ে দেখলেন একেবারে একইরকম দীপ্ত অথচ স্নিগ্ধ মায়ের চেহারা। আনন্দে চোখে জল এল তাঁর। কারিগরদের পুরস্কৃত করলেন সোনার মোহর আর অলঙ্কার দিয়ে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় তখন। পোস্তার মল্লিকবাড়িতে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো।
আরও পড়ুন: ঐতিহ্য আর আভিজাত্যে ইতিহাস বয়ে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো পদ্ধতি
অষ্টমীর দিন বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠা মহিলা ধুনো পোড়ান।
বৈষ্ণবদাস মল্লিকবাড়িতে দেবী একচালার। মাঝে একটি কুলুঙ্গি আছে। তাতে অধিষ্ঠিত থাকেন শিব। তাঁর কোলে দেবী দুর্গা। দুই পাশে পদ্মের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন লক্ষ্মী এবং সরস্বতী। দুইজনেই দেবীর থেকে আকারে অনেক বড়। কার্তিক-গণেশ দুই পাশে। পদ্মের উপরে গনেশ আর ময়ূরের উপরে কার্তিক অধিষ্ঠিত। কুলুঙ্গির নীচে দেবীর বাহন সিংহ রয়েছে দু’টি। এ ছাড়া, দেবীর চালার বাইরে দুইদিকে থাকে জয়া বিজয়ার মূর্তি।
পুজো শুরুর প্রথম দিন থেকেই একটি পটে আঁকা ছবির অনুকরণে তৈরি হয় দেবীর চালচিত্র। বৈষ্ণবদাসের সময় থেকেই পটটি রক্ষিত বাড়িতে। তিনি ছিলেন ঘোর বৈষ্ণব। এই পটটি দেখে দেবীর চালচিত্র আঁকা হবে বলে ঠিক করেছিলেন তিনিই। এতে চিত্রিত রয়েছে বিষ্ণপুরাণ আর চণ্ডীপুরাণ। দুইয়ের মাঝে থাকে দুর্গার মূর্তি। শ্রাবণ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে কাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়। পুজোর ১৫ দিন আগে থেকে চলে চণ্ডীপাঠ।পাঠ করেন তিনজন পুরোহিত। এই দিনথেকেই দশমী পর্যন্ত বাড়িতে কোনও আমিষ ঢোকে না। দশমীর দিন দেবী বিসর্জনের পরে ফের বাড়িতে আমিষ খাওয়া হয়।
বৈষ্ণবদাস মল্লিকবাড়ির ঠাকুরদালানে বরাবর পুজো হলেও গঙ্গাধর মল্লিকবাড়ি, জোড়াবাগান মল্লিকবাড়ি, মানিকতলা মল্লিকবাড়ি এবং ঘড়িওয়ালা মল্লিকবাড়ি- মোট পাঁচটি শরিক বাড়ি মিলে হয় পুজো। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। যেদিন থেকে বাড়িতে চণ্ডীপাঠ শুরু হয়, সেদিন থেকেই দেবীকে অর্পণের জন্য অর্ঘ্য তৈরি শুরু করেন মেয়েরা। তুলোর মধ্যে ধান আর দুর্বা দিয়ে পাকিয়ে সিঁদুর মাখা ছোট ছোট সরায় রাখা হয়। বাড়ির বৌরা পুজোর দিনগুলিতে বেনারসী পরেন। এছাড়াও নাকে নথ এবং পায়ে মল পরতে হয় তাঁদের। বাড়ির পুরুষরা পরেন চেলির চাদর এবং ধুতি।
শ্রাবণ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে কাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়।
বৈষ্ণবদাস মল্লিক বাড়ির কুলদেবতা রাধা-কৃষ্ণ। বাড়ি থেকে খানিক দূরে সেই মন্দির। পুজোর দিনগুলিতে যা কিছু দেবীকে অর্পণ করা হয়, সে সবই পৌঁছে দেওয়া হয় তাঁকেও। অষ্টমীর দিন বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠা মহিলা ধুনো পোড়ান। দু’হাতে দুটো সরা আর মাথায় একটা সরা নিয়ে ধুনো পোড়ানো শুরু হয়। এই ভাবে ৭২ সরা ধুনো পোড়ানো হয়। শেষ দু’বার একবার সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পিঠে এবং সোজা হয়ে শুয়ে বুকে সরা রেখে পোড়ানো হয়।
আরও পড়ুন: করোনা সতর্কতা মেনেই প্রস্তুতি তুঙ্গে বনেদি বাড়ির পুজোয়
ষষ্ঠীর দিন এই বাড়িতে ভিয়েন বসে। খাজা, গজা, বালুসাই, লাড্ডু, দরবেশ- সবই বানানো হয় বাড়িতে। ক্ষীরের মুড়কি, চিঁড়ের মুড়কি, নাড়ুও দেওয়া হয়। এছাড়াও দেওয়া হয় ক্ষীর এবং দই। দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না এ বাড়িতে। পরিবর্তে থাকে লুচি আর পাঁচরকম ভাজা। নবমীর দিন একটি পাত্রে ১৫ কিলো বাটা চিনি ভোগ দেওয়া হয়। এই দিনই সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সবাই মিলে প্রতিমার সামনে উঠোনে নানারকম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। পুজো শুরুর দিন থেকে এই নিয়ম চলছে। বৈষ্ণবদাস মল্লিক ওরিয়েন্টাল সেমিনারির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শোনা যায়, তিনি এই স্কুলের বাচ্চাদের নিয়েও তাঁর বাড়ির পুজোয় নানা অনুষ্ঠান করাতেন।
দশমীর দিন এই বাড়িতে দেবীকে বরণ করার পরে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয়।এর পরে প্রতিমা কাঁধে করে নিয়ে জগন্নাথঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়। আগে জোড়া নৌকায় দেবীর বিসর্জন হত, তখনই ছাড়া হত নীলকন্ঠ পাখি। এখন সে সব প্রথা আর নেই।
পুজো শেষ হয়ে যায়। লোহার গ্যাসবাতিগুলি আবার ঢেকে যায় ধুলোয়। জেগে থাকে শুধু ঠাকুরদালানের গল্পগুলি। আগামী বছর দেবী এলে ধুলোর চাদর সরিয়ে মুখ দেখার অপেক্ষায়। ফের কোলাহলে জেগে ওঠার অপেক্ষায়। এ বছর সেই হট্টগোলও অনেক কম। করোনা পরিস্থিতিতে দর্শনার্থীরা এই বাড়িতে প্রতিমাদর্শনে আসতে পারবেন না।
ছবি সৌজন্য: অমিতাভ গুপ্ত