Durga Puja 2020

ব্রিটিশদের নেকনজরে সিদ্ধিলাভ, দুর্গা পুজো শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়িতে

১৭৫৭ সালে যে পুজো শুরু করলেন তিনি, তেমন পুজো আগে কখনও দেখেনি কলকাতার মানুষ।

Advertisement

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২০ ০৬:০০
Share:

পাল্কির গা বেয়ে মসৃণ আচ্ছাদন নেমে এসেছে সমান্তরাল ভাবে। গাঢ় লাল আর সোনালী বুনোটে জমকালো কাজ। হাতির দাঁত আর সোনার কাজ করা বাঁট ঝকমক করছে আলোয়।সময়টা ১৭৭৫‌ সাল। কলকাতায় তখন এমন পাল্কি খুব বেশি পরিবারের নেই।রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সেই পাল্কি যখন শোভাবাজারের বাড়ি থেকে প্রথম প্রথম বেরোত, পথচলতিমানুষ থমকে যেত দেখে।

Advertisement

রাজা নবকৃষ্ণের চেহারায় যে খুব আলাদা কোনও চমক ছিল তা নয়। কিন্তু একটু নজর করলেই বোঝা যায় চোখেমুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ।অতি সাধারণ অবস্থা থেকেযে জায়গায় এসে পৌঁছলেন তিনি, সে শুধুমাত্র কর্মদক্ষতা আর চাতুর্যের জোরে। নবকৃষ্ণের বাবা রামচরণ দেব ছিলেন কটকের দেওয়ান। সে সময়ে পিণ্ডারি দস্যুদের প্রবল উৎপাত। তা দমন করতে গিয়ে খুবই কম বয়সে মারা যান তিনি। নাবালক সন্তানদের নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন নবকৃষ্ণের মা। তখন তাঁদের বাস ছিল গোবিন্দপুরে। এ দিকে লর্ড ক্লাইভ তখন সেখানে ফোর্ট উইলিয়াম তৈরি করবেন বলে ঠিক করেছেন।ফলে ঠাঁইনাড়া হতে হল দেব পরিবারকে। প্রথমে আরপুলি, তারপর সেখান থেকে শোভাবাজারে চলে এলেন তাঁরা।

আরও পড়ুন: মেয়ের কথা রাখতেই শুরু হয়েছিল সোনার দুর্গাবাড়ির পুজো

Advertisement

জীবনের এই উত্থানপতনই নবকৃষ্ণদেবকে ভেঙে চুরে গড়ে দিল নতুন ভাবে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই নিজ চেষ্টা আর অধ্যবসায়ে তিনি রপ্ত করে নিলেন বেশ কিছু ভাষা। সংস্কৃত, ইংরাজি আর ফার্সিতে তুখোড় হয়ে উঠে এক সময়ে যোগ দিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সির শিক্ষক হিসেবে।কিন্তু এখানেই থেমে থাকার লোক ছিলেন না তিনি। যে কোনও উপায়ে যখন ইংরেজদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন, তখনই সুযোগ এল অপ্রত্যাশিতভাবে। ১৭৫৬ সালে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে দখল করে নিলেন। ইংরেজরা প্রাণভয়ে পালালেন ফলতায়। প্রায় মাস ছয়েক সেখানেই আটকে রইলেন তাঁরা।সে বছরের ডিসেম্বর নাগাদ তৎকালীন মাদ্রাজ থেকে কোম্পানির সৈন্য নিয়ে কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে এলেন ক্লাইভ। সঙ্গে নৌবাহিনি নিয়ে এলেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। এইচ.সি.হিল লিখেছেন, সিরাজের কাছ থেকে কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে ফলতার কাছে আটকে বিপাকে পড়েন ক্লাইভ। সেই সময়েই নিজের আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করে মহা বিপদের হাত থেকে ক্লাইভ-সহ অন্যদের বাঁচালেন নবকৃষ্ণদেব। ইংরেজদের নেক নজরে পড়ার সেই শুরু।

রাজবাড়ির জৌলুস আর জাঁকজমক কমে এলেও যে জিনিসে আজও বদল আসেনি, তা হল নিষ্ঠা।

ব্যবসায়িক সুবিধার আড়ালে ক্রমাগত ক্ষমতা বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণ এবং কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে সিরাজের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ যখন তুঙ্গে, তখনই তৎকালীন মুকসুদাবাদ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা গভর্নর ড্রেকের কাছে সিরাজের বিরুদ্ধে একটি চিঠি পাঠান। তাঁরা শর্ত দেন শুধুমাত্র কোনও হিন্দুই ফার্সিতে লেখা এই চিঠি পড়তে পারবেন। ফাঁপড়ে পড়েন ড্রেক। এবারও ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসেন নবকৃষ্ণদেব। চিঠি পড়ে তার উত্তর লিখে দেন ইংরেজদের হয়ে। এর কিছুকাল পরেই তিনি নিযুক্ত হন মুন্সি পদে। পলাশির যুদ্ধের পুরো সময়কালেই ইংরেজদের অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিলেন তিনি। ক্লাইভও বিমুখ করেননি নবকৃষ্ণ দেবকে। ব্যবসা থেকে শাসন-এ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র কব্জা করতে এমন চতুর দেশীয় ব্যক্তির সাহায্য যে প্রতি মুহূর্তে লাগবে,তা বুঝেছিলেন তিনি। বিশেষ পাল্কির ব্যবস্থার সঙ্গে দিল্লির বাদশাহের কাছে সুপারিশ করে নবকৃষ্ণকে চার হাজার সওয়ারি রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কিছুদিন আগেই। সেই সঙ্গেই নবকৃষ্ণদেবকে দিলেন মহারাজ উপাধি, কোণায় পালক দেওয়া চৌকো টুপি, অস্ত্রশস্ত্র, দেউরিতে পাহারাদার রাখার অনুমতি-সহ আরও অনেক কিছুই। সমাজের একজন গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির যা কিছুদরকার, তার সব কিছুর ব্যবস্থাই করে দিয়েছিলেন ক্লাইভ। পলাশির যুদ্ধ আগেই এই দুই পক্ষের মধ্যে সখ্যের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।তার পরে প্রতিনিয়তই সেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে লাগল। যুদ্ধের পরে সিরাজের সম্পদ যথেচ্ছ লুঠ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার যে বর্ণনা সমসাময়িক বিবরণীতে পাওয়া যায়, তা চমকপ্রদ। লোকমুখে নানা গল্প প্রচলিত ছিল সিরাজের সম্পদ নিয়ে। শোনা যায়, লুঠ করা চুনি-পান্না আর হিরে-জহরতের পরিমাণ এতটাই ছিল যে, বাক্স খুলে তার ঝলকানিতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কোম্পানির এক কর্মচারী। চার বাক্স হীরে-জহরতের সঙ্গে ছিল ১ কোটি ৭৬ লক্ষ রূপোর টাকা, ৩৪ লক্ষ সোনার মোহর এবং আরও বহু কিছু।

আরও পড়ুন: বর্গী হামলায় বন্ধ হয়নি কালনার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো

ক্লাইভ এবং তাঁর সঙ্গীরা আমন্ত্রিত হলেন বটে, কিন্তু পুজো দেখতে হল বর্হিবাটি থেকেই।

সেই লুঠের মালের ভাগ পেলেন রাজা নবকৃষ্ণদেবও। সেই বছরই পলাশির যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে এবং দেশীয় মানুষের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিপত্তি বাড়াতে মহা ধুমধাম করে তিনি শুরু করলেন দুর্গাপুজো। যদিও পুজোর টাকার উৎস এই নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে, নবকৃষ্ণ মুন্সি হিসেবে প্রচুর ‘দান’ পেতেন। সেই দানের টাকাই পুজোর কাজে ব্যবহার করেন তিনি। তবে ঘটনা যাই হোক, ১৭৫৭ সালে যে পুজো শুরু করলেন তিনি, তেমন পুজো আগে কখনও দেখেনি কলকাতার মানুষ। এই উপলক্ষে শোভারাম বসাকের কাছ থেকে প্রায় ১৪ বিঘা জমির উপরে বিরাট এই বাড়িও কিনলেন। শোভাবাজারের এই অংশ হোগলা বনে ঢাকা ছিল। গাছ কাটিয়ে জঙ্গল সাফ করে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন শোভারাম। বাসগৃহের পাশাপাশি নবকৃষ্ণদেব এখানে তৈরি করলেন মনোরম ঠাকুরদালান, তোষাখানা, নহবৎখানা, নায়েব, গোমস্তা, কোষাধ্যক্ষ,পাইক-বরকন্দাজদের থাকার জায়গা, বিরাট বড় গোশালা, অশ্বশালা-সহ আরও বহু কিছু। পলাশির যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ণ স্বরূপ মূল দরজার কাছে বসালেন কামান। নবনির্মিত নাচঘর কাচ দিয়ে ঘিরে এমন ঝাড়বাতি লাগালেন, যার বহুবর্ণী আলো চোখে পড়ে চমক লেগে যেত রীতিমতো। এ পুজোতে রাজা নবকৃষ্ণদেব আমন্ত্রণ জানালেন সাহেব সুবোদেরও। ক্লাইভ থেকে শুরু করে ওয়ারেন হেস্টিংস, পরবর্তীকালে কর্নওয়ালিশ, বেন্টিঙ্ক- কে আসেননি এই পুজোয়! কিন্ত ধর্মভীরু এবং ততোধিক বুদ্ধিমান নবকৃষ্ণদেব ঠাকুরদালানে ম্লেচ্ছদের যাওয়ার রাস্তা রাখলেন না। ক্লাইভ এবং তাঁর সঙ্গীরা আমন্ত্রিত হলেন বটে, কিন্তু পুজো দেখতে হল বর্হিবাটি থেকেই। তিনি এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে, নাচঘর থেকে ঠাকুরদালান দেখা যেত সরাসরি। ঠাকুরদালানে যেতে না পারায় অবশ্য খুব একটা আপত্তি ছিল না কারওরই। সাহেবদের মনোরঞ্জনে লখনউ থেকে বাইজি আনিয়েছিলেন নবকৃষ্ণদেব। অতি সুন্দরী এবং সুগায়িকা নিকি বাইজির নূপুরের আওয়াজ আর সুরাপাত্রের মাদকতা মিলেমিশে মজিয়ে রেখেছিল তাঁদের। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সুরধুনী কাব্যে এই বাড়ির পুজোর বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন, ‘বসিয়াছে বাবুগণ করি রম্য বেশ, মাথায় জরির টুপি বাঁকাইয়া কেশ/ বসেছে সাহেব ধরি চুরুট বদনে/ মেয়াম চকিছে ওষ্ঠ মোহন ব্যঞ্জনে। নাচিছে নর্তকী দুটি কাঁপাইয়া কর মধুর সারঙ্গ বাজে কল মনোহর...”। এখানে সুরা আর অসংযমের স্রোতে ভেসে যেতে লাগল নাচঘর। তবে মূল বাড়ি এবং সংলগ্ন ঠাকুরদালানে কিন্তু এই পরিবেশের আঁচটুকুও লাগতে পারল না। রীতিমতো নিষ্ঠাভরে পুজো করলেন নবকৃষ্ণদেব।পুজোর বিধি তিনি নিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সভাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছ থেকে। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গ দিয়েছিল এই দুই পরিবারই। সখ্য তৈরি হয়েছিল সেই সূত্রে। তর্কপঞ্চাননের পরামর্শমতো সাত্ত্বিক মতে পুজো হবে বলে ঠিক করেন তিনি। মনের মতো করে দেবীকে গড়লেন তিনি। মাথায় দিলেন সোনার মুকুট, হাতে সোনার অস্ত্র। চুলে সাজিয়ে দিলেন ২৬টি সোনার তৈরি স্বর্ণচাঁপা। প্রতিদিন নৈবেদ্যে দিলেন ৩০ মণ চাল। ধুপধুনো, ভোগের গন্ধে, মন্ত্রোচ্চারণে গমগম করতে লাগল বাড়ি। পুজোর দিনগুলিতে অকাতরে দানধ্যান করতেন নবকৃষ্ণদেব। কাঙালী ভোজন থেকে ব্রাহ্মণ বিদায়- সবই ছিল দেখার মতো। নবকৃষ্ণদেব অপুত্রক ছিলেন বলে দাদার ছেলে গোপীমোহন দেবকে দত্তক নিয়ে ছিলেন।এর কিছুদিন পরেই ১৭৮২-তে তাঁর পুত্র রাজকৃষ্ণ দেব জন্মগ্রহণ করেন।এরপরই দেব পরিবারের সম্পত্তি দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়।পুরনো বাড়ির দক্ষিণ দিকে বিশাল আর একটি বাড়ি তৈরি করা হল।১৭৯0-এ সেখানেও শুরু হল দুর্গা পুজো।

আরও পড়ুন: ঐতিহ্য আর আভিজাত্যে ইতিহাস বয়ে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো পদ্ধতি

এরপর কত যুগ চলেগিয়েছে। সেই জৌলুস আর জাঁকজমকের কিছুই আর তেমন অবশিষ্ট নেই। সেই বাইজিরা নেই,যাঁরা নাচঘরে ফুল আর আবিরে পা দিয়ে নাচের ছন্দে এঁকে দিতেন চমৎকার সব ছবি, নেইঅ্যান্টনি কবিয়ালেরকবিগানের আসর। সেবেলোয়ারি ঝাড়বাতি হাজারটুকরো হয়ে ভেঙে গিয়েছে,নাচঘর এখন ভগ্নস্তূপ। কিন্তু যে জিনিসে আজও বদল আসেনি, তা হল নিষ্ঠা। এখনও একইরকম ভক্তি আর শ্রদ্ধা নিয়ে পুজো উদযাপন চলে আসছে দুই বাড়িতেই।

ছবি সৌজন্য: দীপাঞ্জন ভদ্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement