Mankar Durga Puja

সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় মানকরের পর্ণকুটিরে, সেখানেই শুরু বিশ্বাসবাড়ির পুজো

বিশ্বাস পরিবারে কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন। পঞ্চমীতে দেবীর আবাহনের পরে ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়। পঞ্চমীর দিন দেবীর হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়।

Advertisement

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২০ ১২:৩২
Share:

রাত অনেক হয়েছে। নবাব আলিবর্দি খাঁ পায়চারি করছেন অলিন্দে। বর্গী আক্রমণের খবর আসছে চার দিক থেকে। তারা তছনছ করে দিচ্ছে বাংলা। মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ প্রতিহত করতেই কেটে গেল আলিবর্দির সমগ্র রাজ্যকাল। এ বারও এসেছে দস্যুর দল। প্রজাদের হাহাকারে বিচলিত তিনি। কাল সূর্য উঠলেই বর্গী দমনে যাত্রা শুরু করবেন। সৈন্যদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাত আরও গভীর, প্রহরী এসে খবর দিল খাজাঞ্চি তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। একটু অবাকই হলেন আলিবর্দী। এত রাতে? তাঁর নির্দেশে খাজাঞ্চিকে ভিতরে নিয়ে এল প্রহরী। প্রভুকে কিছু কাগজ দেখাতে নিয়ে এসেছেন ওই কর্মচারী। সেগুলি দেখে চমকে গেলেন আলিবর্দি। আজকাল প্রায়ই তাঁকে শত্রু মোকাবিলায় মুর্শিদাবাদের বাইরে থাকতে হয়। প্রাসাদে সেই সুযোগে যে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হচ্ছে তা আন্দাজ করতে পেরেছেন তিনি। এই কাগজ চক্রান্তকারীদের হাতে পড়লে সমূহ বিপদ। তাঁর রাজধানীতে ফেরা পর্যন্ত কাগজগুলিকে নিজের হেফাজতেই রাখার নির্দেশ দিলেন খাজাঞ্চিকে।

Advertisement

এই সুযোগের সন্ধানেই ছিল বিরোধীরা। আলিবর্দি মুর্শিদাবাদ ছাড়া মাত্র সেগুলির সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। সাংঘাতিক আহত হয়েও কাগজগুলি রক্ষা করলেন খাজাঞ্চি। ফিরে এসে কর্মচারীর বিশ্বস্ততায় তুষ্ট নবাব বিপুল ধনসম্পত্তি দিলেন পুরস্কার স্বরূপ, সেই সঙ্গে বিশ্বাস উপাধি। আগের গঙ্গোপাধ্যায় পদবী ছেড়ে বিশ্বাস পদবী ব্যবহার করতে শুরু করলেন খাজাঞ্চি। এর কিছু দিন পরই মুর্শিদাবাদ থেকে দিগনগরে এসে বসবাস শুরু করল এই পরিবার। সেই সঙ্গে শুরু করল তসরের ব্যবসা। যে অর্থ নবাব দিয়েছিলেন, তা রাতারাতি কয়েক গুণ হয়ে গেল। এই পরিবারেরই সদস্য রামমোহন বিশ্বাসের আমলে বিশ্বাস পরিবার আরও ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি লাভ করল। কিন্তু রামমোহনবাবুর সব থাকা সত্ত্বেও ঘর ছিল অন্ধকার। নিঃসন্তান ছিলেন তিনি।

শেষপর্যন্ত গুরুর পরামর্শে দিগনগরের সমস্ত সম্পত্তি ত্যাগ করে পুত্রলাভের আশায় নিঃস্ব অবস্থায় বর্ধমানের মানকরে চলে এলেন তিনি। ছোট একচালা ঘর থেকে নতুন করে শুরু করলেন সব। সেখানে এসে দুর্গাপুজো শুরু করলেন তিনি। দেবী এলেন সাধারণ পর্ণ কুটিরেই। একচালার ঘর আলো হল মায়ের আগমনে। মা দুর্গার আশীর্বাদে রামমোহনবাবুর স্ত্রী-র কোল আলো করে এল সন্তান। দেবীর কৃপায় পুত্রলাভ করলেন বলে ছেলের নাম দিলেন দুর্গাদাস। কাশ্মীর রাজ্যের দেওয়ান মহেশচন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন এই পরিবারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুরুষ। স্বামী বিবেকানন্দ কাশ্মীর ভ্রমণকালে যখন কাশ্মীররাজ অমরসিংহের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন তখন তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। স্বামীজি সেই সময়ে কাশ্মীরে একটি মঠ তৈরি করার পরিকল্পনা করছিলেন। সে বিষয়ে মহেশবাবুর সাহায্য তাঁর দরকার ছিল।

Advertisement

আরও পড়ুন: ঈর্ষাতেই নিজগৃহে দেবীর বোধনের ইচ্ছা হল রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের

বিশ্বাস পরিবারে কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন। পঞ্চমীতে দেবীর আবাহনের পরে ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়। পঞ্চমীর দিন দেবীর হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীকে পরানো হয় গয়না। টায়রা, টিকলি, নথ কোমরবন্ধনী, সীতাহার, নুপূর আর মুকুটে সাজানো হয় মাকে। সপ্তমীর দিন বাড়ির যে সব ছেলেদের নতুন পৈতে হয়েছে, তারা রুপোর দোলায় করে কলাবৌকে পুকুরে স্নানে নিয়ে যায়। পুজো শুরুর আগে কুললক্ষ্মীকে দালানে দেবীর পাশে নিয়ে আসেন মহিলারা। বিশ্বাস বাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয়। তবে এখানে মেয়েরা ভোগ রান্না করতে পারেন না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পুরুষরাই ভোগ রান্নার অধিকার পান। সপ্তমীর দিন সাত রকম ভাজা, পোলাও, ডাল, পায়েস দেওয়া হয়। অষ্টমীর দিন আট রকম ভাজা আর খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। নবমীর দিন দেওয়া হয় ভাত, আট রকম ভাজা আর পায়েস। অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে আটটা বিরাট থালায় চাল দিয়ে তাতে বাতাসা, মণ্ডা, সাত-আট কেজির কদমা সাজিয়ে দেওয়া হয়। সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী এই তিন দিনই এই বাড়িতে ছাগ বলি হয়। আগে সন্ধিপুজোয় কামান দাগা হত। এখন আর সে প্রথা নেই। পরিবর্তে শূন্যে গুলি চালিয়ে সন্ধিপুজোর সূচনা করা হয়। সেই সঙ্গে ঠাকুরদালানের চার কোনায় চার ব্যক্তি মশাল হাতে দাঁড়ান। মশাল আর প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয় ওঠে ঠাকুরদালান। নবমীর দিন নরনারায়ণ সেবা হয় এ বাড়িতে। আশপাশের গ্রামের আড়াই-তিন হাজার মানুষ মা দুর্গার প্রসাদ পান। বাড়িতে নবমী পুজোর পর গ্রামের দেবতা পঞ্চাননের মন্দিরে যাওয়া হয়। সেখানে পুজো দিয়ে আরও একটি বলি হয়। দশমীর দিন বাড়ির পুকুরেই ঘট বিসর্জনের পর কলাবৌ বিসর্জন হয়। এর পরে দেবীকে দালান থেকে উঠোনে নামিয়ে বরণ করেন মেয়েরা। বিশ্বাস বাড়িতে দেবীর গায়ের রং ভোরের আলোর মতো। বিদায়ের সময়ে দেবীকে যখন উঠোনের আল্পনা দেওয়া টুকটুকে লাল মেঝেতে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়, তখন সে রং যেন মেদুর হয় বিদায়ের বেদনায়। শান্ত হয়ে যায় তাঁর রুদ্র রূপ। পরিবারের বিশ্বাস, দেবীর এই যাওয়া আবার ফিরে আসারই জন্য।

করোনাকালেও এই বাড়ির দরজা অতিথিদের জন্য খোলা রাখবেন বিশ্বাস পরিবারের সদস্যরা। তবে মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব মেনে প্রতিমাদর্শনে যাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন: মা লক্ষ্মী ঘরের মেয়ে, তাই বিদায় দেয় না বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement