ভাগীরথীর তীরবর্তী একদা নব্য-ন্যায় ও স্মৃতিচর্চার পীঠস্থান ভট্টপল্লি বা ভাটপাড়াবাংলার সারস্বত চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।ঘোষপাড়া রোডের ধার ঘেঁষা ডাইনে-বাঁয়ে অবস্থিত প্রশস্ত কিংবা সঙ্কীর্ণ গলিগুলিতে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন বাড়িগুলি কালের স্রোতে আজ জৌলুসহীন, মলিন। ইটের ফাঁকে ফাঁকে ইতস্তত উঁকি দেয় বর্ষাসিক্ত সতেজ শ্যাওলা আর আগাছা।তারই উপর জমে থাকা কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জলে অস্তগামী সূর্যের আলো উস্কে দেয় গৌরবময় অতীত।
অর্ধশতাব্দী আগেও যে সব ঠাকুরদালান ন্যায়তীর্থ কিংবা স্মৃতিতীর্থেদের মন্ত্রউচ্চারণে গমগম করত, আজ ফেলে আসা দিনের সে সব স্মৃতি হাতছানি দেয় পুজোর দিনগুলিতে।চাকচিক্য, জৌলুস কিংবা আড়ম্বর নয়, এখানকার দুর্গোৎসবের মূল আকর্ষণ একনিষ্ঠ আচার ও ভক্তি। অতীতে ভাটপাড়ার বহু ব্রাহ্মণ পরিবারে, এমনকি অব্রাহ্মণ পরিবারেও দুর্গোৎসবের প্রচলন ছিল। বর্তমানে অবশ্য টিকে আছে মাত্র কয়েকটি।
ভাটপাড়ার প্রাচীনতম পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম পাঁচবাটি পাড়ার মহামহোপাধ্যায় রাখালদাস ন্যায়রত্নের বাড়ির পুজো। বর্তমানে যা শক্তিপদ স্মৃতিতীর্থের (ঘটরাম ঠাকুরের)বাড়ির পুজো বলে পরিচিত।সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রাহ্মণরা ভাটপাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।বশিষ্ঠ গোত্রীয় ওই ব্রাহ্মণরা যশোর থেকে এসেছিলেন ভাটপাড়ায়।জানা যায়, পরিবারের আদিপুরুষ নারায়ণ ঠাকুর (পরবর্তী কালের নারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ নন) যশোর থেকে ভাটপাড়ায়গঙ্গাস্নানে আসতেন। ভাটপাড়ার তৎকালীন জমিদার পরমানন্দ হালদার নারায়ণ ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেনএবং তাঁকে ভাটপাড়ায় বসবাস করার জন্য অনুরোধ করেন। পরমানন্দকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেও ভাটপাড়ায় বসবাস করতে রাজি হননিতিনি।তবে পরে তাঁর পৌত্র চন্দ্রশেখর ভাটপাড়ায় বসবাস শুরু করেন।
তাঁরই উত্তরপুরুষ রামগোপাল বিদ্যাবাগীশ বিশিষ্ট নৈয়ায়িক ছিলেন।বিশেষআর্থিক সঙ্গতিপন্ন না হলেও তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।কথিত, এক বার চণ্ডীপাঠ করাকালীন একটি পাখি তাঁর সামনে একটি মোহর ফেলে রেখে পালায়।এর পরে তিনি মেদিনীপুরের এক স্থানীয় জমিদারের কাছ থেকে বেশ কিছু সম্পত্তি পেয়ে আর্থিক সঙ্গতিপন্ন হয়ে ওঠেন। এই পরিবারের দুর্গাপুজো ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল, তা জানা না গেলেও অনুমান করা হয় রামগোপালের সময় থেকেই পুজোর সূচনা।প্রবাদপ্রতিম নৈয়ায়িক মহামহোপাধ্যায় রাখালদাস ন্যায়রত্নেরবৃদ্ধ প্রপিতামহ রামগোপাল। তাঁর বাবা সীতানাথের সময়ে যে পুজো হত, তার প্রমাণ রয়েছে শিবচন্দ্র সর্বভৌমের একটি গ্রন্থে।
আরও পড়ুন: বাঘের উপদ্রব আজ অতীত, আন্দুল রায়বাড়িতে এখনও দশমীতে পূজিত হন দক্ষিণরায়
এক কালের বহু প্রসিদ্ধ টোল এবং চতুষ্পাঠীর ঠিকানা ভাটপাড়া আজ দ্রুত পরিবর্তনশীল।অতীতের সেই সব দিন এখন শুধুই স্মৃতি।গোপীকৃষ্ণ গোস্বামীরোডের জরাজীর্ণ পুরনো সাহিত্যমন্দিরটি আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।বট-অশ্বত্থের মজবুত শিকড় যেন প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে অতীতের গৌরবময় স্মৃতিচিহ্নটুকু ধরে রাখার।
সীতানাথ কিংবা রাখালদাসের সময়কার প্রাচীন দালানটি আজ আর নেই। এখন পুজো হয় পরবর্তী কালে নির্মিত দালানে।এখানে পূজিত হয় একচালার সাবেক প্রতিমা।সাবেক প্রথা মেনে আজও সব আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। জন্মাষ্টমীর দিনে হয় কাঠামো পুজো।পারিবারিক রীতি অনুসারে সপ্তমীর দিননবপত্রিকার স্নানপর্ব গঙ্গায় নয়, ঠাকুরদালানেই সারা হয়।
আরও পড়ুন: বৌদ্ধতন্ত্রাচারে পুজো পান বলাগড় পাটুলির দ্বিভুজা দুর্গা
এই পরিবারের অন্যতম প্রবীন সদস্য রঘুনাথ ব্যাকরণ স্মৃতিতীর্থ জানালেন, আজও কয়েক শতাব্দী প্রাচীন পারিবারিক পুঁথির পদ্ধতি অনুসারে পুজো হয়।বোধন হয় ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়।এখানে পুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। যদিও পুজোয়কোনও পশুবলিহয় না।এখানকার পুজোর বিশেষত্ব হলসন্ধিপুজার সময় চামুণ্ডার নয়, দুর্গারই পুজো করা হয়। পুজোয় সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। অতীতে পুজোয় ভোগ রাঁধতেন কেবলমাত্র স্বগোষ্ঠীর দীক্ষিত ব্রাহ্মণরা।এ বাড়ির পুজোর ভোগে থাকে নানা পদ। যেমন সাদা ভাত, খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, ডাল, ভাজা, চচ্চড়ি, এঁচোড়ের ডালনা, কচুরশাক, কলার বড়া, বিভিন্ন রকমের চাটনি, পায়েস।
ঋণ: ভাটপাড়ার পুরনো পুজো: দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য