হাওড়া শহর ছেড়ে ডোমজুড়, বড়গাছিয়া পেরিয়ে জগৎবল্লভপুর থানার অন্তর্গত মুন্সিরহাট এখনও আধা শহর, আধা গ্রাম। বর্ষা শেষে প্রকৃতি যেন একটু একটু করে জানান দেয় শরতের আগমন বার্তা। শুভ্র কাশের ঝালর দোলা, ঝলমলে সোনালি রোদ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, কিংবা রাতশেষে পাতারডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু এনে দেয় শরতের পূর্ণ আমেজ। সবুজে ঘেরা এই বর্ধিষ্ণু, প্রাচীন জনপদে কালের স্রোতে টিকে থাকা কিছু সাবেক বাড়ির আশপাশেই আজ মাথা তুলেছে হাল আমলের বাড়িঘর। ক্রমেই স্মৃতির খাতায় নাম লেখাচ্ছে অতীতের মাটির বাড়িগুলি।
তবু আজও পুজোর দিনগুলিতে এলাকার আবালবৃদ্ধবনিতার অন্যতম আকর্ষণ এখানকার খড়দা, ব্রাহ্মণপাড়ার মল্লিকবাড়ির বহু প্রাচীন পুজোটি। দূরে কয়েকটি সর্বজনীন পুজো হলেও এলাকার মানুষের আবেগ, ভক্তি ও বিশ্বাস মিশে আছে এই পুজোয়। বাড়ির সামনে কয়েক শতাব্দীর পুরনো অশ্বত্থ গাছটি যেন কালের নীরব সাক্ষী।
আরও পড়ুন: গঙ্গাস্নানেরপরে পুজোর কাজে অনুমতি মেলে মুন্সিরহাট মল্লিকবাড়িতে
স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন পরিবারের সদস্য উত্তমকুমার মল্লিক। জানালেন- পুজো কবে শুরু হয়েছিল, তার সঠিক হিসেব না থাকলেও প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পুজো চলে আসছে। অতীতে এই পরিবারের বসবাস ছিল হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়ার অযোধ্যা গ্রামে। সেখানেই পুজোর সূচনা। পরে পরিবারের এক সদস্য মুন্সিরহাটে বসবাস শুরু করলে পুজোটিও স্থানান্তরিত হয়। অতীতে এই পরিবারের সদস্যদের পদবি ছিল দে। শোনা যায়, এই পরিবারের আদি পুরুষ এই গ্রামে এসে দরিদ্র ও দুঃস্থদের সাহায্যের হাত বাড়ানোয় তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে মল্লিক পদবি ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের জমিদারি লাভ করেছিলেন।আবার অন্য একটি কাহিনি অনুসারে এই পরিবার মল্লিকা চালের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কোনও একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আশপাশের গ্রামের জমিদার ও নিমন্ত্রিতরা মল্লিকা চালের ভাত খেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের মল্লিক উপাধি দিয়েছিলেন।
স্মৃতির খাতায় নাম লেখাচ্ছে অতীতের মাটির বাড়িগুলি।
আগে পুজো হতো খড়ের চালের আটচালায়। পরে তিনটি খিলানযুক্ত পাকা দালান তৈরি হয়। অলঙ্করণযুক্ত থামওয়ালা প্রধান ফটক এবং বাড়িটিতে প্রাচীনত্বের ছাপ স্পষ্ট। এ বাড়ির পুজোয় কিছু নিয়ম আছে।যেমন বাড়ির ছেলে-মেয়েরা বাগান থেকে ফুল তোলেন। বংশ পরম্পরায় একটি পরিবার এই পুজোর ফুল ও মালা দিয়ে আসছেন। পুরনো রীতি মেনে মহালয়ার দিন গঙ্গা থেকে পুজোর জল আনা হয়। পরিবারের সদস্যরা যাঁরা পুজোর জোগাড় করেন কিংবা নৈবেদ্য সাজান, পুজোর আগে তাঁরা বাড়ির রীতি মেনে গঙ্গাস্নান করেন। পুজোর আগে ও পরে আটচালা শোধন করা হয় গোবর দিয়ে। তেমনই সপ্তমীতে বাড়ির প্রতিটি দরজায় গেঁড়িমাটি দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: পুজো শেষে দেবীর মুকুট পরানো হয় বেতাইচণ্ডীকে
আজও সন্ধিপুজোয় চল্লিশ কিলো চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। সাবেক রীতির প্রতিমার গায়ে শোভা পায় সোনা ও রুপোর গয়না। এই পরিবারে অন্নভোগ না হলেও বাড়ির মেয়েরা রাতের শীতল ভোগের লুচি তৈরি করেন।পুজোয় এখনও পশুবলি হয়। পুজোর কদিন ব্রাহ্মণ ভোজনেরও রীতি আছে।
দশমীর দিনে বাড়ির ছেলেরাই দুর্গা প্রতিমাকে বেদী থেকে নামান। কয়েক বছর আগেও বাড়ির সদস্যরা কাঁধে করেই প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে যেতেন। এখন অবশ্য ইঞ্জিনভ্যানে শোভাযাত্রা করে প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে যাওয়া হয়। বিসর্জনের পরে বাড়ির সকলে একসঙ্গে খিচুড়ি ভোগ খান। এই পরিবারের গৃহ দেবতা শ্রীধরজিউ। পরিবারের শ্রীশ্রী শ্রীধরজিউ এস্টেট থেকে পারিবারিক দুর্গা ও জগদ্ধাত্রীপুজো এবং সারা বছর অন্যান্য পালাপার্বণ অনুষ্ঠিত হয়।
সাবেক রীতির প্রতিমার গায়ে শোভা পায় সোনা ও রুপোর গয়না।
প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ পুজোর দিনগুলিতে মল্লিকবাড়িতে আসেন। তবে এ বার ছবিটা অন্য রকম।পরিবারের সদস্য সুমন মল্লিক জানালেন, এ বছর করোনা পরিস্থিতিতে যথা সাধ্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হবে। এ ছাড়া পুজো দেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা বিধি মানা হবে।
ছবি: পরিবার সূত্রে পাওয়া।