আর চিকের আড়ালে নয়। বাড়ির মহিলারা পুজো দেখেন ঠাকুরদালানে পা রেখেই। আরও বহু প্রাচীন রীতির সঙ্গে চিকের আব্রু আজ বিলুপ্ত হাটখোলা দত্ত পরিবারের দুর্গোৎসবে। তবে প্রাচীন বনেদি পরিবারের এই পুজোয় এখনও পালিত হয় সাবেকিয়ানার আরও বহু খুঁটিনাটি।
ঐতিহ্যবাহী এই পুজো শুরু হয়েছিল ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর হাটখোলায় ভদ্রাসন পত্তন করেছিলেন জগৎরাম দত্ত। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্র রামজয়ের উত্তরসূরিরা বর্তমানে এই পুজোর মূল হোতা। রামজয়ের মেজ ছেলে কাশীনাথের শাখা বহু দিন আগেই এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। ছোট ছেলে হরসুন্দরের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল হুগলির কোন্নগরের মিত্র পরিবারে।
দত্ত পরিবার বৈষ্ণব। খাঁটি বৈষ্ণবীয় রীতি মেনে হওয়া এই শক্তি আরাধনায় জীববলি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বলি দেওয়া হয় ক্ষীরের পুতুল। সেই বলিও দেওয়া হয় আড়াল রক্ষা করে। কারণ, পরিবারের কোনও সদস্যের যে কোনও বলি দেখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বৈষ্ণব ধারা মেনে এই বাড়ির ঠাকুরদালানে মা দুর্গার সামনে সাজানো হয় নিরামিষ ভোগ। বিশুদ্ধ ঘিয়ে ভাজা লুচি আর চিনির গুঁড়ো এই পুজোর ভোগের মূল বৈশিষ্ট্য। চিনিগুঁড়ো মানে, বাটা চিনি। নিরামিষ ভোগপ্রসাদে আরও বহু উপাদান থাকলেও দশভুজার সামনে লুচির পাশে গুঁড়ো চিনি থাকবেই।
২২৫ বছরের প্রাচীন এই পুজোয় কার্তিক থাকেন যোদ্ধার বেশে। তিনি এখানে দেবসেনাপতির বেশে। প্রতিমা, ভোগের পাশাপাশি এই পুজোর বিশেষত্ব জড়িয়ে আছে অন্যখানেও। হাটখোলা দত্তবাড়ির দালানে বিজয়া দশমীতে কোনও সিঁদুরখেলা হয় না। চলে আসা রীতি মেনে সিঁদুরখেলা হয় মহাষ্টমীতে। বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পরে বাড়ির সদস্যরা গঙ্গার ঘাট থেকে স্বদেশি গান গাইতে গাইতে বাড়িতে ফেরেন। তার পর শূন্য ঠাকুরদালানের সামনে সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেয়ে ওঠেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি। একে একে পালিত হয় আলিঙ্গন, শান্তির জল এবং অন্যান্য সব প্রথা।
স্বাধীনতার আগে স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে কোনও ভাবে হাটখোলা দত্ত পরিবারের পুজোর সঙ্গে এই রীতি জড়িয়ে গিয়েছিল। তার পর কেটেছে বহু দশক। কিন্তু এখনও হাটখোলা দত্তবাড়ির পুজোর বিসর্জনে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে দেশাত্মবোধক সুরও।