Durga Puja 2019 Ananda utsav 2019 Durga Puja Celebration

কালের নিয়মে জীর্ণ বাকসা সিংহ বাড়ির পুজো আজও ঐতিহ্যে অমলিন

একসময় যে বাড়ির খ্যাতি আর জৌলুসের শেষ ছিল না, কালের ছায়ায় সেই সিংহবাড়ি আজ দীর্ণ জীর্ণ।

Advertisement

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৬:৩৮
Share:

বট অশ্বত্থের ছায়া চারিদিক থেকে ঢেকে রেখেছে গ্রামটাকে। পিছন দিক থেকে মহাশ্মশান পেরিয়ে বয়ে যাচ্ছে শীর্ণ সরস্বতী নদী। ছায়াঘেরা শ্যামল গ্রামটিতে একসময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কিছু প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বাড়ি। আর সেই সঙ্গে ছিল অনেকগুলি মন্দির। এর মধ্যে কিছু বাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে। কিছু মন্দিরও ভগ্নপ্রায়। নিষ্প্রদীপ সন্ধ্যায় খাঁ খাঁ করে সেগুলি। কিছু মন্দিরে আজও প্রতি সন্ধ্যায় বেজে ওঠে কাঁসরঘণ্টা, ধূপ দীপ বাতি জ্বলে।

Advertisement

হুগলির জনাইয়ের কাছে এই জায়গার নাম বাকসা গ্রাম কেন তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বিস্তর। কেউ কেউ বলেন, একসময় এখানে প্রচুর বাক্সবাদামের গাছ ছিল, তার থেকেই গ্রামের নাম বাকসা। মতান্তরে বকসিকা নামে এক শাসক ছিলেন এই এলাকায়। তাঁর নাম থেকেই গ্রামের নাম। বহু বছর আগে মহেন্দ্রনাথ সিংহ নামে মুর্শিদাবাদ রাজপরিবারের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী তৎকালীন বেগমপুর এবং কেশবপুরে কিছু জমিজায়গা কিনে বসবাস করতে আসেন। সরস্বতী নদীকে ঘিরে তখন বেশ কিছু বড় বাড়ি ছিল এই এলাকায়। করিৎকর্মা এবং বুদ্ধিমান এই ব্যক্তি কিছু দিনের মধ্যেই বিস্তর জমিজমার মালিক হয়ে বসেন।

মহেন্দ্রনাথ সিংহ ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের উত্তরপুরুষ। ১৯২১ সালে বসন্তকুমার বসুর লেখা ‘কায়স্থ পরিচয়’ বইটিতে এই পরিবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘জোড়াসাঁকোর সিংহ বংশ একটি প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত বংশ। ইহাদের আদিনিবাস হুগলি জেলার অন্তর্গত বাকসা গ্রামে। এই বংশোদ্ভব মহেন্দ্রনাথ সিংহের হইতে এই বংশের বংশধর আরম্ভ হয়।’ বইটি থেকে জানা যায়, সিংহবংশের পঞ্চমপুরুষ শান্তিরাম সিংহ বাকসা থেকে জোড়াসাঁকোয় চলে যান। জোড়াসাঁকোর সিংহবংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। শান্তিরামের প্রপৌত্র নন্দরাম সিংহের ছেলে ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’কে বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে মাইলস্টোন হিসেবে ধরা হয়। বইটির ভাষা, বিষয়বস্তু সবই রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল তৎকালীন বঙ্গসমাজে। মহাভারতের বাংলা অনুবাদ বা বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ, সমাজসংস্কার ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের অবদান কম নয়। মহেন্দ্রনাথ সিংহর সময়েই এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়।

Advertisement

একসময় যে বাড়ির খ্যাতি আর জৌলুসের শেষ ছিল না, কালের ছায়ায় সেই সিংহবাড়ি আজ দীর্ণ জীর্ণ। ঠাকুরদালানেও ফাটল ধরেছে জায়গায় জায়গায়। তা-ও ভগ্ন ঠাকুরদালান হেসে ওঠে পুজোর কয়েকটা দিন। কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীতে। দেবীর বোধন হয় প্রতিপদে। সাবেক রীতি মেনে একচালার ঠাকুর হয়। ঠাকুরের অঙ্গে থাকে শোলার সাজ। ঠাকুরের এখানে চিন্ময়ী রূপ। চালচিত্রে দেবীর পিছনে থাকেন শিব আর দুই পাশে থাকেন জয়া এবং বিজয়া। ষষ্ঠীর দিন ঠাকুরকে গয়না পরানো হয়। সপ্তমীর দিন সকালে দ্বাদশ শিবমন্দিরের পিছনে সরস্বতী নদীতে কলাবউকে স্নান করানো হয়।

এই বাড়ির কুলদেবতা শ্রীধর। আর বাহির দেবতা শীতলামাতা। পুজো শুরুর আগে ঢাক ঢোল বাজিয়ে ফল মূল নৈবেদ্য নিয়ে গ্রামের তিন দেবতা— বিশালাক্ষী মাতা, বদ্যি মাতা এবং শীতলা মাকে পুজো করা হয়। এই পুজো সম্পন্ন হলে তবেই বাড়ির পুজো শুরু হয়। পুজোর দিন সারা পাড়া ভিড় করে আসে বাড়িতে। অষ্টমীর দিন পুজোর যাবতীয় জোগাড় করেন পুরুষরা। পুজো শুরু হলে মেয়েরা আর মাটির দালান পেরিয়ে ঠাকুরের কাছে যেতে পারতেন না। পুজো শেষে দালানে প্রদীপ জ্বালাতে যান তাঁরা। সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী— এই তিন দিন সকাল বিকেল আরতির সময়ে মাটির ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। আগে এই বাড়িতে মোষবলি হত। তবে এখন মোষ বলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সন্ধিপুজোর সময় এখনও এই বাড়িতে ছাগল বলি হয়। এ ছাড়াও আখ, বাতাবি লেবু ও ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয় নবমীর দিন। পুজোর সময় গৃহদেবতা শ্রীধরকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। সেই সঙ্গে নিয়ে আসা হয় কুললক্ষ্মীকেও। নবমীর দিন পুজো শেষে এঁদের আবার তুলে দেওয়া হয় ঠাকুরঘরে। পুজোর সময় প্রায় ১০০টি নারকেলের নাড়ু বানানোর নিয়ম এই এলাকায়। প্রতিটি পুজো বাড়িতেই এই নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। সকালে নানা রকম ফল আর রাতে লুচি ভোগ দেওয়া হয় ঠাকুরকে। সেই সঙ্গে থাকে নাড়ু লাড্ডু সন্দেশ, আরও নানা রকম মিষ্টি। পুরনো প্রথা মেনে সরস্বতী নদীতে দেবীকে বিসর্জন দেয় সিংহ পরিবার।

ছবি: শুভজিৎ দত্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement