যুদ্ধ কীসে হয়..! 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' সিনেমায় গুপীর মুখে অনুপ ঘোষালের সেই অমর গানে এ হেন প্রশ্নের উত্তর আজও হাওয়ায় আর্তনাদ তোলে! এই সময়ের প্যালেস্টাইন- ইজরায়েল যুদ্ধ সারা পৃথিবীর আলোচনার কেন্দ্রে!
সম্ভবত আমাদের জীবদ্দশায় এ রকম বিধ্বংসী যুদ্ধ খুব একটা দেখা যায়নি। যুদ্ধবিরতি কেউ চাইছে, কেউ চাইছে না। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!
এই সময়কালে আমার-আপনার মনে উস্কে উঠতেই পারে সারা জীবনে দেখা বা অদেখা যুদ্ধ-কেন্দ্রিক বিদেশি, এমনকি দেশি সিনেমার স্মৃতি। তেমনই ১০টা ছবির কথা এই লেখায়। না দেখে থাকলে, যা অবশ্যই দেখবেন, আর দেখে থাকলে আবার করে দেখতে পারেন অধুনা নানান সমাজ মাধ্যমে!
১. ডানকার্ক - মুক্তি - ২০১৭। ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - ক্রিস্টোফার নোলান (সিনেমাটির কাহিনির লেখকও)।প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - ফিওন হোয়াইটহেড, টম গ্লিন কার্নি, হ্যারি স্টাইলস (এটি তাঁর অভিষেক সিনেমা), প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের হাত থেকে মিত্র বাহিনীর দ্বারা উত্তর ফ্রান্সের ডানক্রিক বন্দর উদ্ধারের লড়াইকে কেন্দ্র করে। ফরাসি ছাড়াও ব্রিটিশ ও বেলজিয়ান সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে যোগ দেয়। তাৎপর্য - সিনেমাটির শুটিংয়ে এক হাজারেরও বেশি 'একস্ট্রা' লেগেছিল। ডানকার্ক বন্দরের তৎকালীন সত্যিকারের নৌকা জোগাড় করা হয় শুটিং করতে।
২. দ্য মাউন্টেন ম্যান (মাঝি) - মুক্তির সাল - ২০১৫। ভাষা - হিন্দি পরিচালক - কেতন মেহতা। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, রাধিকা আপ্তে, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, প্রমুখ। সিনেমাটি যে লড়াই কেন্দ্রিক - দশরথ মাঝির জীবনযুদ্ধ অবলম্বনে নির্মিত। যিনি 'মাউন্টেন ম্যান' নামে পৃথিবী বিখ্যাত। বিহারের গয়া জেলার গেহলর গ্রামের বাসিন্দা দশরথের বাসস্থানের পাশে একটি পাহাড় সবাইকে হেঁটে উঠে, টপকে পেরোতে হত, এমনকী হঠাৎ প্রাণদায়ী ওষুধ কিনে আনতে হলেও। দশরথের গর্ভবতী স্ত্রীরও একবার সেই দুর্দশা ঘটেছিল। অকুতোভয় ও অকল্পনীয় পরিশ্রমী দশরথ কেবল একটা হাতুড়ি ও ছেনি নিয়ে সেই পাহাড় দিনের পর দিন ভেঙে-ভেঙে তার মাঝে রাস্তা বার করেছিলেন। শুধু একটা হাতুড়ি-ছেনির সাহায্যে পাহাড় খুঁড়ে ৩০ ফুট চওড়া ও ৩৬০ ফুট লম্বা পথ! তাৎপর্য - এ দেশের কমপক্ষে নব্বই শতাংশ চলচ্চিত্র সমালোচকরা সিনেমাটির রেটিং দিয়েছিলেন পাঁচে পাঁচ! যা এক বিরলতম নজির।
৩. নো ম্যান'স্ ল্যান্ড - মুক্তির সাল - ২০০১ ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - দানিশ তানোভিচ প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - ব্র্যাঙ্কো ডুরিচ, ফিলিপ সোভাগোভিচ, রেনে বিটোরাজাক, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - চলতি শতাব্দীর প্রথম বছরে বসনিয়ান-সার্ব যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে। যুযুধান বসনিয়াক ও বসনিয়ান সার্বের একজন করে সেনা দু'পক্ষের 'নো ম্যান'স্ ল্যান্ডে' ধরা পড়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দেয়। একে অন্যের প্রাণ নেওয়ার জন্য দুজনেই অপেক্ষায় ছিল অন্ধকার নামার। কিন্তু তার মধ্যেই দু'জনে সেখানে আহত একজন তৃতীয় সেনার শুশ্রুষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামে। শুরু হয় জীবন বাঁচানোর অন্য এক লড়াই! তাৎপর্য - এটি এমন এক যুদ্ধ কেন্দ্রিক সিনেমা, যা বসনিয়ান যুদ্ধ চলার সময়েই নির্মিত!
৪. টার্টেলস ক্যান ফ্লাই - মুক্তির সাল - ২০০৪। ভাষা - আরবি ও ইংরেজি। পরিচালক - বাহম্যান ঘোবাদি। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - সোরান ইব্রাহিম, আভাজ লতিফ, আজিল জিবারি, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - কুর্দি যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। যুদ্ধের জেরে ইরাক-তুর্কি সীমান্তে এক কুর্দি শরণার্থী শিবির কেন্দ্রিক কাহিনি। তাৎপর্য - সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর এটি ইরাকে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র।
৫. জিরো ডার্ক থার্টি - মুক্তির সাল - ২০১২। ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - ক্যাথরিন বিগেলো। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - জেসিকা চ্যাস্টেইন, জেসন ক্লার্ক, কাইল চ্যান্ডলার, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - ২০০১-এর ৯/১১'এ আল কায়দা জঙ্গিদের নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের 'টুইন টাওয়ার' ওসামা বিন লাদেনের জন্য প্রায় এক দশকব্যাপি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে বানানো বিতর্কিত একটি ছবি। তাৎপর্য - দলীয়করণের অভিযোগে এটি এক বিতর্কিত সিনেমা। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা-র বিরোধীদের দাবি ছিল, তাঁকে দ্বিতীয় বার দেশের প্রধান বানানোর প্রচারের জন্য ঠিক ওই বছরের অক্টোবর মাসে আমেরিকার নির্বাচনের সময়েই সিনেমাটির মুক্তি ঘটানো হয়েছে।
৬. দ্য হার্ট লকার - মুক্তির সাল - ২০০৮। ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - ক্যাথরিন বিগেলো। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - জেরেমি রেনার, অ্যান্টনি ম্যাকি, রেফ ফাইঞ্জ, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - ২০০৩ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের যুদ্ধের উপর নির্মিত। তাৎপর্য - এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের ইতিহাসে পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী পরিচালক পরিচালিত প্রথম সিনেমা।
৭. সেভিং প্রাইভেট রায়ান - মুক্তির সাল - ১৯৯৮। ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - স্টিফেন স্পিলবার্গ। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - টম হ্যাঙ্কস, ম্যাট ডেমন, এডওয়ার্ড বার্নস, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায়। ফ্রান্সের নরম্যান্ড আক্রমণ-ভিত্তিক। ওহামা সৈকতে নামার জন্য মার্কিন সেনারা যখন তৈরি হচ্ছে, জার্মান সৈন্যবাহিনীর শিকার হয়। কিন্তু যারা বেঁচেছিল, তারাই শেষমেশ পরাস্ত করে জার্মানদের। তাৎপর্য - তৈরির খরচের পাঁচ গুণ আর্থিক লাভ করেছিল সিনেমাটি। যা তৎকালীন রেকর্ড।
৮. শিন্ডলার্স লিস্ট - মুক্তির সাল - ১৯৯৩। ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - স্টিফেন স্পিলবার্গ। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - বেন কিংসলি, লিয়াম নিসন, ক্যারোলিন গুডাল, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলারের জীবন অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র। যিনি একজন জার্মান হয়েও ওই যুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনীর দ্বারা প্রচুর পোলিশ ইহুদিদের গণহত্যার প্রচেষ্টাকে রোধ করে ইহুদিদের উদ্ধার করেন। তাৎপর্য - ১৯৯৪ সালের অ্যাকাডেমি পুরস্কার মঞ্চে এক সঙ্গে একাই সাতটি অস্কার জিতে এই মার্কিন চলচ্চিত্রটি ঐতিহাসিক হয়ে আছে।
৯. লাইফ ইজ বিউটিফুল - মুক্তির সাল - ১৯৯৭। ভাষা - ইতালীয় ও ইংরেজি। পরিচালক - রবার্তো বেনিনি। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - রবার্তো বেনিনি ও নিকোলেত্তা ব্রাস্কি। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - ছবির পরিচালক বেনিনি এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এক ইহুদি ইতালীয় বইয়ের দোকানের মালিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যিনি নিজের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার আশ্রয় নিয়ে তাঁর ছেলেকে নাৎসি 'কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে'র ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেন কী ভাবে, সেটাই সিনেমার পটভূমি। তাৎপর্য - বেনিনির বাবা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সত্যিই ইতালীয় সেনা হিসেবে দু'বছর জার্মান ত্রাণ শিবিরে নিয়োজিত ছিলেন। যেটি হয়তো পরিচালককে অনুপ্রেরিত করেছে। ছবিটি ২০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছিল। অইংরেজি সিনেমার এটি বিশ্বে রেকর্ড আয় এখনও।৯. লাইফ ইজ বিউটিফুল - মুক্তির সাল - ১৯৯৭। ভাষা - ইতালীয় ও ইংরেজি। পরিচালক - রবার্তো বেনিনি। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - রবার্তো বেনিনি ও নিকোলেত্তা ব্রাস্কি। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - ছবির পরিচালক বেনিনি এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এক ইহুদি ইতালীয় বইয়ের দোকানের মালিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যিনি নিজের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার আশ্রয় নিয়ে তাঁর ছেলেকে নাৎসি 'কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে'র ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেন কী ভাবে, সেটাই সিনেমার পটভূমি। তাৎপর্য - বেনিনির বাবা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সত্যিই ইতালীয় সেনা হিসেবে দু'বছর জার্মান ত্রাণ শিবিরে নিয়োজিত ছিলেন। যেটি হয়তো পরিচালককে অনুপ্রেরিত করেছে। ছবিটি ২০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছিল। অইংরেজি সিনেমার এটি বিশ্বে রেকর্ড আয় এখনও।
১০. দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই - মুক্তির সাল - ১৯৫৭। ভাষা - ইংরেজি। পরিচালক - ডেভিড লিন। প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী - জ্যাক হকিংস, উইলিয়াম হল্ডেন, আলেক গিনেস, প্রমুখ। সিনেমাটি যে যুদ্ধ-কেন্দ্রিক - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন্দ্রিক। ১৯৪২-৪৩ সালে বার্মা রেলওয়ে অনুকরণে তৈরি। তৎকালীন জাপান অধ্যুষিত বর্তমান থাইল্যান্ডে এক বন্দি শিবিরের ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দিদের কাওয়াই নদীর উপর সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয় জাপানি কর্নেল সাইটো-র তত্ত্বাবধানে। কিন্তু যুদ্ধবন্দিদের শ্রমে বাধ্য করা যায় না, এই দাবিতে বন্দি ব্রিটিশ কর্নেল নিকেলসন বিদ্রোহ করেন। তাঁকে একটা ছোট টিনের বাক্সে জল ও খাদ্য ছাড়াই পুরে রাখা হয়। তাতেও তিনি আপোস করেননি। শেষমেশ সমঝোতায় আসেন জাপানি কর্নেল। তাৎপর্য - আজ পর্যন্ত যুদ্ধ-কেন্দ্রিক বিখ্যাত সিনেমাগুলোর মধ্যে এটি চিরস্মরণীয় মহাকাব্যিকের মর্যাদা পেয়ে আসছে।