পুজোর সময় রেস্তরাঁয় না-খেলে বাঙালি তার ধর্মে পতিত হয়। এই তিনটে দিন যে মানুষ বাড়িতে খায়, সে ঘোর পাতকী। নরকেও তার ঠাঁই হয় না। এই সময় কলকাতার বড়, মেজ বা ছোট— সব ধরনের রেস্তরাঁর সামনেই গাদাগাদি ভিড় লেগে থাকে। ভিড় লেগে থাকে মোগলাই, চিনে এবং বাঙালি রেস্তরাঁর সামনে এবং পপুলার ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোতে। আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের মুখের ভাব দেখে মনে হয়, গত হপ্তায় তাদের পেটে কোনও দানাপানিই পড়েনি। আর অপেক্ষা-করা মানুষের দলে কোনও বাচ্চা থাকলে সে তো শুরু থেকেই চিলচিৎকার করতে থাকে! তখন তার বাবা-মা মুখে এমন একটা এক্সপ্রেশন দ্যায়, যেন ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তারা এই রেস্তরাঁর সামনে এক-পায়ে খালি পেটে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এই সব দিনে, হাউসফুল রেস্তরাঁর বন্ধ দরজা সামান্য খুলে, কিছু সময় অন্তর অন্তর সেখানকার এক জন কর্মচারী টিপটপ ইউনিফর্ম পরে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার মাথায় থাকে চকচকে পাগড়ি বা টুপি। হাতে থাকে একখানা ছোট্ট প্যাড আর পেনসিল। সে এসে, অপেক্ষা-করা প্রতিটা গ্রুপের এক জন করে প্রতিনিধির নাম আর তাদের খেতে বসার জন্য ঠিক কতগুলো সিট দরকার তা লিখে নেয় ওই প্যাডে। যদি ভেতরে কোনও টেবিল ফাঁকা হয়, তবে সেখানে যত জন মানুষ বসতে পারবে সেই হিসেব করে লোক ঢুকিয়ে নেয়। এই লোকটি যত বার দরজা ঠেলে বাইরে উঁকি দ্যায়, তত বার দু’-চার জন ক্ষুধার্ত বাঙালি শিকারি লেপার্ডের মতো গুঁড়ি-মেরে এগিয়ে যায় তার দিকে, সিট ফাঁকা হল কি না সেই খবর নিতে। হাতের প্যাড দেখে যেই এক জনের নাম ডাকা হয়, অমনি সে তার সঙ্গীদের নিয়ে তড়িঘড়ি রেস্তরাঁর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে!
ভেতরে ঢুকে তারা যে টেবিলটা পায়, অনেক সময় দেখা যায় সেটায় তখনও দু’-একটি এঁটো থালা বা কাঁটা-চামচ পড়ে আছে। সেটা তখন তাদের বসে থাকা অবস্থাতেই পরিষ্কার করা হয়। আর এই সময় তাদের কোলের ওপর দু’-এক দানা এঁটো খাবার ঝরে পড়াটা মোটেই বিচিত্র কিছু নয়।
টেবিলে বেশ কিছু ক্ষণ বসে থাকার পর অর্ডার নেওয়ার জন্য এক জন ওয়েটার এসে দাঁড়ায় এবং ঝটপট-ঝটপট অর্ডার নিতে থাকে। সাধারণ সময় তাকে কাস্টমারের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় মেনুর রকমফের নিয়ে আলোচনা করতে দেখা গেলেও, পুজোর সময় তার মধ্যে যেন অদ্ভুত এক ছটফটানি কাজ করে। দেখে মনে হয়, এই অর্ডারটা নিয়েই সে যেন এই রেস্তরাঁ ছেড়ে পাঁইপাঁই করে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যাবে। তখন তাকে আর কেউই খুঁজে পাবে না। মাঝে মাঝে ওই অর্ডারটি লিখে নিয়ে যাবার মিনিট দশেক পরে সেই ওয়েটারটিকে আবার কাঁচুমাচু মুখে ফিরে আসতে দেখা যায়। এসে সে জানায়, মেন কোর্সের একটি আকর্ষণীয় পদ, ধরা যাক চিকেন ফ্রায়েডরাইস, এখন আর সার্ভ করা সম্ভব হচ্ছে না। বদলে, যে কোনও ধরনের নুডলস সার্ভ করা যেতেই পারে।
আরও পড়ুন: পুজোয় পার্টির প্ল্যান? আড্ডা আর খাওয়ার ঠিকানা হোক ‘দ্য ব্রিউহিভ’!
এর পর আবার মিনিট পাঁচেক গুনগুন-গুনগুন। রাষ্ট্রপুঞ্জের অত্যন্ত গোপনীয় আলাপ-আলোচনা। তারপর আবার অর্ডার। বলা বাহুল্য, এই বদলে দেওয়া অর্ডারটি হাতে নিয়েও সেই ওয়েটারটি আগের মতোই হুস করে হারিয়ে যাবে। এ বার এই অর্ডারটা পাতে আসতে আসতে আরও মিনিট দশ-বারো। আর এই ভাবে চলে আসা খাবারদাবার খেতে খেতে যদি নতুন কোনও আইটেম অর্ডার দেওয়া হয় কিংবা প্রথম বারে আনানো কোনও বিশেষ পদ দু’-এক প্লেট রিপিট করতে বলা হয়, তবে তা পেতে পেতে মিনিমাম পনেরো-কুড়ি মিনিট লেগে যাবে।
খাওয়াদাওয়া শেষের দিকে এগলে, মানে, যখন বোঝা যাবে আর নতুন কোনও প্লেট অর্ডার দেওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন ওয়েটার এসে শেষ বারের মতো জিগ্যেস করবে আর কিছু লাগবে কি না। উত্তর যদি ‘না’ হয়, তখন তারা দ্রুতগতিতে বিল তৈরি করতে চলে যাবে। আর এই বিলটি যদি ঠিকঠাক দেখে না-নেওয়া হয়, তবে পুজোর বাজারে তার মধ্যে এমন কিছু পদের টাকা যোগ হয়ে থাকতেই পারে, যেগুলো এই খানেওয়ালা দলটি না-খেয়ে হয়তো অন্য কোনও টেবিলের লোক খেয়েছে। কিন্তু অত হাসি-ঠাট্টা-গল্পের মধ্যে ওই বিলটি ধরে ঠান্ডা মাথায় আইটেম-ওয়াইজ চেক করা, পুজোর বাজারে মুশকিল তো বটেই বরং বলা ভালো ‘না মুমকিন হ্যায়’।
আরও পড়ুন: কষা মাংস থেকে টর্চড রসগোল্লা, বাঙালি রসনার গন্তব্য এবার ‘দ্য ওয়েস্টিন কলকাতা’
এ কথা তো সবারই জানা যে, পুজোর ক’দিন যে কোনও রেস্তরাঁর খাবার, মানের দিক দিয়ে এবং পরিমাণের দিক থেকে কমে যায়। দ্রুত রান্না করে সার্ভ করতে হয় বলে খাসি বা ভেড়ার মাংসের মতো পদ সবসময় সুসিদ্ধ হয় না। এই ঝামেলা এড়ানোর জন্য কোনও কোনও রেস্তরাঁ আগে থাকতেই এক-আধটা পদ বেশ কিছুটা প্রসেস করে বড়সড় ফ্রিজারে ঢুকিয়ে রাখে। ফলে ফ্রিজ থেকে বের করে, গ্রেভির সঙ্গে কিছুটা তেলমশলা-সহ ফুটিয়ে তা টেবিলে গরম-গরম পরিবেশন করার সময় অনেক পদেরই আসল স্বাদ এবং গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। মোগলাই খানার দোকানে কিছু কিছু বোনলেস মাংসের টুকরো কাবাব তৈরি করার জন্য ডিপফ্রিজে তুলে রাখা হয়। যার প্রতিটি টুকরোর একদম মাঝখানের অংশটি, তাওয়ার আগুনে ভাল ভাবে সেঁকে নেওয়ার পরেও কিছুটা যেন শক্তই থাকে। যেমন শক্ত থাকে তাড়াহুড়োয় বানানো ফিরনির ভেতরে আতপ চালের দানাগুলি। পুজোর সন্ধেবেলায় ভিড়ের মধ্যে কাজের স্পিড বাড়াবার জন্য শশা, পেঁয়াজ, গাজর— এমন কিছু সব্জি কুচিয়ে স্যালাডের জন্য বিকেল থাকতেই আলাদা করে তুলে রাখা হয়। বেশি ক্ষণ হয়ে গেলে এদের গায়ে সোঁদাটে গন্ধ চলে আসে এবং সরস ভাব কমে যায়। তবু বাঙালিরা এদের বিনা প্রশ্নে হাসিমুখে গ্রহণ করে, কারণ এরাই হল পুজোর রেস্তরাঁর অলঙ্কার।
তবে সবচেয়ে মজার কথা হল, পুজোর সময় এই সব খাবারদাবার খেয়েই বাঙালিরা এত মোহিত হয় যে, তারা বাড়িতেও কিছু খাবার প্যাক করে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুক্তকণ্ঠে অর্ডার করে। আর তার পরিমাণ যে সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেকটাই কম হবে, এটা সে দেখেও যেন দ্যাখে না, বুঝেও যেন বুঝতে চায় না। যে বা যারা বাড়িতে রয়েছে তারা যখন খাবারের পার্সেলটি হাতে পায়, তখন যদি তারা এর কোয়ালিটি বা কোয়ান্টিটি নিয়ে কিছু বলতে চায়, তবে যে সেটা কিনে নিয়ে এসেছে, সে ওই কথাগুলো এ-কান দিয়ে ঢুকিয়ে, ও-কান দিয়ে বার করে দ্যায়। আর সব কথার শেষে যে শেষ কথাটি বলে সে শেষ করে, তার সারমর্ম হল, ওরে বাপু, এই পুজোর বাজারে কত ক্ষণ কষ্ট করে লাইন দিয়ে এই খাবার হাতে পেয়েছি আর কত কষ্ট করে তা রাস্তার ভিড়ের ধাক্কা বাঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছি এটাই শুধু এক বার ভেবে দ্যাখো। ক’দানা খাবার কম পেলে বা নুন-মিষ্টি ক’আনা কম হল, এই নিয়ে মনখারাপ কোরো না। এখন পুজোর সময়, তাই হোটেল-ঠাকুরের প্রসাদ ভেবে এই সব খাবার কপালে ঠেকিয়ে খেয়ে নাও এবং প্রাণ ভরে আনন্দ কর!
কার্টুন : দেবাশীষ দেব