কালী পুজো মানেই দেদার বাজির ফোয়ারা। আর বাজির কথা বললেই মনে পড়ে যায় একটাই নাম- বুড়িমা! কালী পুজো হোক বা দুর্গা পুজোর ভাসান, বিয়ে হোক বা ম্যাচ জেতার আনন্দ সবেতেই একটা জিনিস কিন্তু চাই। তা হল বুড়িমার বাজি। কিন্তু জানেন কি, কে এই বুড়িমা? কী তাঁর আসল পরিচয়?
বেশ কয়েক বছর হল এ রাজ্যে শব্দবাজি নিষিদ্ধ। তবু আশি ও নব্বইয়ের দশকেও যাদের ছেলেবেলা কেটেছে, তাদের শৈশব, কৈশোর জুড়ে ছিল বুড়িমার চকোলেট বোম, তারাবাতি-সহ বিভিন্ন বাজি। আর সেই বাজির বাজার মাতানো সাফল্যের পিছনে তিনি। অন্নপূর্ণা দাস। ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে থেকেও যিনি অদম্য জেদে নিজেই হয়ে উঠেছেন ব্র্যান্ড। বুড়িমা মানে এক বাঙালি মহিলার একা টিকে থাকার গল্পও বটে।
দেশভাগের সময় ভারতে চলে আসতে হয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে। এ দেশে প্রথমে ঠাঁই হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। গঙ্গারামপুরে থাকতে হারালেন স্বামীকে। শুরু হল অন্নপূর্ণার জীবন সংগ্রাম। সব্জি বিক্রি করতেও পিছপা হননি। বিড়ি বাঁধার কাজ শুরু করে গড়ে তোলেন বিড়ি কারখানা।
তত দিনে অবশ্য ঠিকানা বদলেছে। এসেছেন বেলুড়ে। কিনেছেন নিজের প্রথম দোকান, তাও ন’শো টাকার বিনিময়ে।
রং থেকে প্রতিমা- সব কিছুরই ব্যবসা করেছেন অন্নপূর্ণা। আর তা থেকেই এক দিন ইচ্ছা হল বাজির ব্যবসা শুরু করার। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। বাজি কিনে এনে দোকান সাজালেন। এ দিকে, অনুমতিই যে নেই! দু’দিন পর সে দোকান ভেঙে দিল পুলিশ।
তবে তাতে দমে যাওয়ার পাত্রী মোটেই নন অন্নপূর্ণা। কিছু দিনের মধ্যেই জোগাড় করে ফেললেন অনুমতিপত্র। তবে শুধু তাতেই তো আর চলে না। বাজি কিনে এনে বিক্রি করতে গেলে ঢের ঝামেলা। কমে যায় লাভের অঙ্ক। নিজেই যদি বাজি তৈরি করতে পারা যায়, তার চেয়ে ভাল আর কিছু নেই।
কিন্তু বাজি তৈরি শেখাবে কে? সেই সময়েই অন্নপূর্ণার আলাপ হল বাঁকড়ার আকবর আলির সঙ্গে। হাতে ধরে তিনিই শেখালেন বাজি বানানোর কায়দা। কাকে বলে সোরা, ব্যাটরা। গন্ধক দেখতেই বা কী রকম? একটু একটু করে অন্নপূর্ণা শিখে ফেললেন সব।
আর তাতেই বাজিমাত! আকবরের চকোলেট বোমার রেসিপি বাজারে ফাটল তাদের বানানোর বোমার মতোই সশব্দে! যাত্রা শুরু করল ব্র্যান্ড ‘বুড়িমা’।
ডানকুনিতে এ বার কারখানার জন্য জমি কেনা। সেখানেই মাথা তুলে রমরমিয়ে চলল ব্যবসা। পরে অবশ্য সেই জমি দান করে দেওয়া হয়েছে পঞ্চাশটি দরিদ্র পরিবারকে তাদের বসবাসের জন্য। এমনই দরদী ছিলেন অন্নপূর্ণা, ওরফে সবার বুড়িমা।
নাতি সুমন দাসের স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করে বুড়িমার মৃত্যু দিনটি। বাড়িতে শোকের ছায়া। হঠাৎ বাইরে বিকট আওয়াজ! চকোলেট বোমা। বাড়ির লোক বিরক্ত হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এল, “যে চকলেট বোম বানিয়ে গোটা বাজির বাজার জিতে নিয়েছিলেন তিনি, তা ফাটিয়েই বুড়িমাকে শ্রদ্ধা জানালাম!”
পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি আইনত নিষিদ্ধ। কেনা, বেচা বা ফাটানোর শাস্তি হতে পারে কারাবাস থেকে জরিমানা।