‘কালী কালী বল রসনা’, এ গান লিখেছেন বাংলারই শাক্ত সাধক। বাংলায় কালী ছিলেন এক শ্মশানবাসিনী দেবী। তান্ত্রিকেরা শ্মশান বা লোকালয়ের বাইরে কালীর আরাধনা করতেন।
বাংলায় কালী পুজোর প্রবর্তক বলা যায় নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দের আগে বাংলায় তন্ত্রসাধনা ছিল বেশ একটা গা ছমছম ব্যাপার। তাঁরই পূজ্য দেবী আগমেশ্বরী।
কৃষ্ণানন্দ কালীকে সাধারণের কাছে তুলে ধরলেন খানিকটা। এখন কালীর যে রূপ, মনে করা হয় সেই দক্ষিণাকালী এসেছে তাঁর হাত ধরেই।
কৃষ্ণানন্দের শিষ্য ছিলেন রামপ্রসাদ। তিনি তাঁর রামপ্রসাদী গানের সুরে, ভয়ঙ্করী রূপের দেবী কালীকে করে তুললেন নিজের মা।
শ্মশানবাসিনী নিরাভরণ শাক্ত-তান্ত্রিকদের কালীই হয়ে উঠলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে। ১৭২৩ সালে জন্ম নেন রামপ্রসাদ সেন। আগল ভাঙলেন তিনিই। তান্ত্রিক-কাপালিকদের তন্ত্রসাধনার থেকে তৎকালীন বঙ্গসমাজ খানিকটা দূরত্বই বজায় রাখত। ফলত কালীও সাধারণ বঙ্গীয় সমাজের অঙ্গ ছিল না। এই দূরত্ব প্রথম ভেঙে দেন সাধক রামপ্রসাদ সেন।
ভক্তিবাদী শাক্ত ভাবনা তাঁর হাত ধরেই এল বাংলায়। শ্যামা পুজো আসলে ভক্তি আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি। কারণ ভক্তি আন্দোলনেও ঈশ্বরের নারী ভাব প্রাধান্য পেয়েছিল।
কালীকে নিয়ে তাঁর একের পর এক 'প্রসাদী গান' বা ‘রামপ্রসাদী গান’ ছড়াতে লাগল লোকমুখে। ‘এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা, মন রে কৃষিকাজ জান না’-র মতো গান আজও বাংলার ঘরে ঘরে গাওয়া হয়।
শোনা যায়, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পৃষ্টপোষকতাতেই খানিকটা জমি পান তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন মন্দির।
আজও রামপ্রসাদের এই ভিটে, তাঁর পঞ্চবটীর আসন রয়েছে হালিশহরে।এই ভিটেতেই নিজে হাতে মূর্তি গড়ে কালীর পুজো করতেন সাধক কবি।
জনশ্রুতি, ১৭৮১ সালে এমনই এক দীপান্বিতা অমাবস্যার পরের দিন কালীর মূর্তি মাথায় নিয়ে নিজের লেখা শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে নাকি গঙ্গায় বিলীন হয়ে যান রামপ্রসাদ। তবে তাঁর লেখা গান ছাড়া আজও বাংলার কালীপুজো অসম্পূর্ণ।
রামপ্রসাদের জন্মের কিছু বছর পর ১৭৭০ সালে জন্ম কমলাকান্ত ভট্টাচার্যে ওরফে সাধক কমলাকান্তের। তিনি জন্মেছিলেন পূর্ব বর্ধমানের অম্বিকা কালনার সেনপাড়ায়। রাজা তেজচন্দ্র তাঁর অবাধ্য সন্তানের শিক্ষার দায়ভার তুলে দেন সাধক কমলাকান্তের হাতে। কিন্তু কেন?
কথিত আছে সাধক কমলাকান্ত মহারাজ তেজচাঁদকে দেবী মূর্তির পায়ে কাঁটা বিধিঁয়ে রক্ত দেখিয়েছিলেন। সাধক কমলাকান্ত রচিত শ্যামাসংগীত এবং শাক্ত পদাবলী আজও মুখে ফেরে। ‘ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথা পেলি, সদানন্দময়ী কালী’— তাঁরই রচনা।
মৃত্যুর সময় নাকি গঙ্গায় স্নানে যাওয়ার শখ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু কালীকে ছেড়ে যেতেও চাইছিলেন না। তাঁর জন্য নাকি স্বয়ং গঙ্গা মাটি ফুঁড়ে আবির্ভাব হয়েছিল বর্ধমানের বোরহাটের ওই মন্দিরে। পরবর্তী কালে ওই জায়গাটিতে একটি পাতকুয়ো আজও রয়েছে যার জল নাকি কখনও শুকোয়নি।
নবজাগরণের সময় যুক্তিবাদী তরুণ নরেনও এসেছিলেন রামকৃষ্ণের কাছে। ঠাকুর সাফ জানিয়ে দেন, যুক্তি বোধের চেয়েও বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। যত মত, তত পথ। কোন পথ নরেনের, সেটি নরেন ঠিক করুক।
নবজাগরণের পরবর্তী সময়ে নতুন ভাবে ভক্তিভাবের জোয়ার বইল কালীকে ঘিরে। পরবর্তীকালে নরেন অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস আর যুক্তির মিশেলে সংশয়ের আর কোনও জায়গাই রাখলেন না।
রামকৃষ্ণের হাত ধরেই শ্যামাকে ভয়ের সঙ্গে ভক্তিও করতে শুরু করলেন এ বাংলার মানুষ। বাংলায় তন্ত্রসাধক এবং কালীসাধক হিসেবে আরও অজস্র জনের নাম পাওয়া যায়। এমনই এক সাধক বামাখ্যাপা।
বীরভূমের আটলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি ১৮১৩ সালে। এই মহাসাধকের আসল নাম ছিল বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। কিশোর বয়সেই ঘর ছেড়ে আসেন তারাপীঠের মহাশ্মশানে।
তারাপীঠের তন্ত্রসাধক কৈলাসপতি বাবার কাছে দীক্ষা নেন বামাখ্যাপা। তারাপীঠে বামাখ্যাপার অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় নানা সময়ে ভক্তেরা পেয়েছেন বলে শোনা যায়।
কথিত আছে, মা তারা সাধক বামাখ্যাপাকে ভয়ঙ্কর বেশে দর্শন দেন। পরে মাতৃবেশে কোলেও তুলে নেন। মন্দিরের নিয়ম মানতেন না, নিজের খেয়ালে দেবতার থালা থেকেই নাকি নৈবেদ্য তুলে খেয়ে নিতেন বামাখ্যাপা। শক্তিপীঠ তারাপীঠের সঙ্গে জড়িয়ে এই সাধকের নাম।
অবিভক্ত বাংলার তন্ত্রসাধকদের কথা বলতে গেলে এক জনের নাম না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি সাধক সর্বানন্দ। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি বা মেহারের এই কালীমন্দির প্রখ্যাত তন্ত্রসাধক সর্বানন্দদেবের সাধনপীঠ।
সর্বানন্দদেব মেহারেই সিদ্ধিলাভ করেন বলে জানা যায়। যে বটগাছের নীচে তিনি সাধনা করেছিলেন, সেটিই পূজ্য। এখনও সেটি একই অবস্থায় রয়েছে বলে জনশ্রুতি।
সর্বানন্দ ও তাঁর সহচর পূর্ণানন্দের সাধনার পীঠস্থানই হল মেহার কালীবাড়ি। অতীতে এখানে কোনও মূর্তি ছিল না। পরে প্রতিষ্ঠা করা হয় কষ্টিপাথরের দশমহাবিদ্যা মূর্তি।
পৌষ মাসের উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে সর্বানন্দ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ভক্তের ইচ্ছায় নাকি কালী তাঁর নখ দিয়ে অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় মেহার আলোকিত করেন। মেহার হল শক্তিপীঠ। বাংলা তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান। অজস্র সাধকের জন্মস্থানও। তাঁরই মধ্যে কয়েক জনের কথা তুলে ধরা হল এখানে।