নস্কর বাড়ির দেবী দুর্গা। নিজস্ব চিত্র
শুরু থেকেই পুজোর রীতিনীতি আলাদা নস্কর বাড়িতে। শাস্ত্র মেনে পুজো হলেও নবাবি আদবকায়দা থেকে গিয়েছে আজও। আজও দেবীকে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় ছ’মন চাল। শুরুতে বাড়ির ছ’ভাই প্রত্যেকেই এক মন করে চাল নৈবেদ্য দিতেন দেবীকে। সেই থেকেই এই নিয়ম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নস্কর বাড়ির পুজো জৌলুশ হারালেও খামতি থাকে না আয়োজনে। আজও প্রাচীন রীতি মেনেই দুর্গা ও রাধাগোবিন্দ এক সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছেন এই বাড়িতে।
নস্কর বাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিরাট ইতিহাস। তখন বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ। তাঁর আমলে রায়দিঘির ছত্রভোগের বাসিন্দা রামচন্দ্র লস্কর ছিলেন নবাবের দেওয়ান। নীলাচল যাত্রার সময় চৈতন্য মহাপ্রভু কয়েক দিন ছত্রভোগে অবস্থান করেছিলেন। কথিত আছে, দেওয়ান রামচন্দ্র সেই সময় মহাপ্রভুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে বৈষ্ণব হন। দীর্ঘ দিন সীমান্ত শাসক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করায় নবাব খুশি হয়ে তাঁকে ‘খাঁ’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় ‘খাঁ লস্কর’ পদবী ব্যবহার করেন রামচন্দ্রর বংশধরেরা।
তিন পুরুষ ধরে সেই পদবী ব্যবহারের পর তাঁর পৌত্র রামজীবন ‘খাঁ-লস্কর’ ত্যাগ করে নস্কর পদবী গ্রহণ করেন। পরে তিনি ও তাঁর পাঁচ ভাই চলে আসেন মন্দিরবাজারের জগদীশপুর গ্রামে। তারও প্রায় ২৫ বছর পর আনুমানিক ১১২০ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে নস্কর বাড়িতে প্রথম পালিত হয় দুর্গা পুজো। ছ’ভাই মিলে পুজো শুরু করায় ৩০০ বছরের বেশি পুরনো নস্কর বাড়ির এই পুজোকে ‘ছয় বুড়োর পুজো’ নামেই চেনেন এলাকার বাসিন্দারা।
নস্কর বাড়িতে দুর্গাপুজোর জন্য এক সময় তৈরি করা হয়েছিল বিশাল চণ্ডীমণ্ডপ। সামনে ছিল আটচালা। পুজোর কদিন এলাকার বাসিন্দাদের ভিড় লেগেই থাকত ওই বাড়িতে। প্রতি দিন আটচালায় বসত গানবাজনার আসর। পুরোহিত, ঢাকি, মৃৎশিল্পী, ময়রা এবং বস্ত্রব্যবসায়ীদের আগাম চাষের জমি দিয়ে রাখা হত। তাঁরা সারা বছর সেই জমিতে চাষ করতেন। বিনিময়ে দুর্গাপুজোর সময় নস্কর বাড়িতে তাঁরা পুজোর কাজ করতেন। এ ভাবেই চলছিল বছরের পর বছর ধরে।
মূলত পারিবারিক পুজো হলেও উৎসবের কয়েক মাস আগে থেকে শুরু হয় প্রস্তুতি। পরিবারের সকলেই অংশগ্রহণ করেন এই পুজোয়। রীতি অনুযায়ী মহালয়ার পরের দিনই হয় দেবীর বোধন। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত নস্কর বাড়িতে চলত পংক্তি ভোজের আয়োজন। সেই রীতি আজও মেনে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে নস্কর বাড়ি।
গত বছর থেকে করোনা অতিমারির জেরে সেই ছবিটি কিছুটা হলেও বদলেছে। বাড়ির প্রবীণ সদস্য রাধাকৃষ্ণ নস্করের কথায়, ‘‘নবাবি আমলে মহা ধূমধাম করে পুজো হত। এখনও প্রাচীন রীতি রেওয়াজ মেনেই আমাদের বাড়িতে পুজো হয়। দুর্গা এবং রাধাগোবিন্দের পুজো এক সঙ্গে হয় এখানে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুজোর বহর কমেছে। কিন্তু আয়োজনে কোনও খামতি রাখা হয় না৷ আমি নিজে ১৫ বছর পুজো করেছি। এখন তরুণ প্রজন্মও পুজো করতে আগ্রহী। তারাই এখনও পুজো চালিয়ে যাচ্ছে।’’