ঋতাভরী চক্রবর্তী
বড্ড সরল ছিল ছোটবেলার পুজো। পুজোর জামা গোনা ছিল মস্ত এক কাজ। যাতে আমার পাওয়া জামার সংখ্যা বেশি হয়, তার জন্য স্কার্ট আর টপ আলাদা করে গুনতাম। প্যান্ট আর শার্টও আলাদা ভাবে গোনা হত। শাড়ি তখন কিনে দেওয়া হত না। মায়ের শাড়িই পরতাম। কিন্তু ব্লাউজ আর পেটিকোট কিনে দিলে ওটাও আলাদা করে গুনতাম। জুতোও থাকত সেই গুনতিতে। নবমীর সকালে আমাদের নাচের শিক্ষিকা পাড়ার সব খুদেদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে যেতেন। সারি দিয়ে ঠাকুর দেখার সৌভাগ্য এখন আর হয় না। সে সব অতীত।
আমার সবচেয়ে পছন্দের দিন ছিল ষষ্ঠী। ওই দিন ভোরে সব কচিকাঁচারা মিলে আগমনীতে অংশ নিতাম। মায়েদের শাড়ি পরে রবি ঠাকুরের ৭-৮টা গান গেয়ে, তার সঙ্গে নেচে নেচে সারা পাড়া ঘুরতাম। আর বড়রা বাড়ির বারান্দা থেকে আমাদের প্রভাতফেরী দেখতেন। অনেকে আবার ফুল ছুঁড়ে দিতেন। এই স্মৃতিটুকু আমার কাছে খুব জ্বলন্ত। বার বার মনে হয় যদি ফিরে যেতে পারতাম ওই সময়টায়, কী ভালই না হতো।
এখনকার পুজো মানেই এক গুচ্ছ কাজ। এ বারও যেমন পুজোর ছবি রিলিজ় রয়েছে আমার। এখন ঠাকুর দেখাটাও কাজের দৌলতেই। সে সবও খুবই সুন্দর। এখন আর সারি বেঁধে প্যান্ডেলে যেতে হয় না। অনেকটাই সহজ সব কিছু। কিন্তু তাও, কাজ তো কাজই। তার সঙ্গে যতই পুজোকে যুক্ত করি না কেন, আসলে তো সেটা ওই কাজই। আগের মতো মুক্তির ডানা আর রয়েছে কই! যা খুশি করার আর অবকাশ নেই।
তবে এখনও একটি নিয়ম আমরা পালন করি আগের মতো। অন্তত একটা দিন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় এবং পরিবারের সবাই মিলে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। নিজেরা রান্না করার সময় পাই না বলে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে কেবল আড্ডা আর আড্ডা।
এই বছর আমেরিকা থেকে আমার তিন বন্ধু কলকাতা আসছে। তাঁরা কেবল লোকমুখে শুনেছে যে, ঋতাভরী পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এখনও তারা চাক্ষুষ করেনি আমি জীবনটা। আমার প্রতি আমার অনুরাগীদের ভালবাসার কথা শুনেইছে কেবল। এ বার দেখবেও। আমি যে কয়েকটি পুজো পরিক্রমায় যাব, ওদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব। প্রথম বার বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো দেখবে তাঁরা। সম্ভবত ‘বহুরূপী’র প্রিমিয়ারেও তাঁরা থাকবে আমার সঙ্গে। ওদের চোখ দিয়ে নতুন করে পুজো দেখতে পারব আমি। তাদের চোখের সেই বিস্ময় আমাকে আনন্দ দেবে খুবই।
দুর্গাপুজো আরও একটি কারণে আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার স্কুলের মূক ও বধির বাচ্চাদের পুজোর উপহার দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকি এই সময়ে। ওদের মুখে হাসি ফুটলে বড় আরাম হয়।
অনেক ঝড়ঝাপ্টা গেল আমাদের সকলের উপর দিয়ে, এখনও থামেনি সে রেশ। থামবেও না। কেউ উৎসবে ফিরতে চান, কেউ চান না। কোনওটাই কাউকে অপমান করা নয়। যে যার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সেই অধিকার তাঁদের রয়েছে।
মা দুর্গা অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তি নিয়ে আসেন। গত এক দেড় মাসে কত কত অশুভ শক্তি ঘিরে রেখেছিল আমাদের। দুর্নীতির কুৎসিত রূপ আমরা দেখতে পেলাম এই কয়েকদিনে। আমি কেবল প্রার্থনা করব, মা যেন আমাদের শক্তি দেন, আমরা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও তীব্র ভাবে রুখে দাঁড়াতে পারি। চাকরিহীনতা, রোগ, দূষণ, এমনিতেই এই সমস্ত কিছুকে নিয়েই বাঁচতে হয় আমাদের। তার পর যদি এমন মানুষ, এমন পুরুষ আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাহলে শক্তি ছাড়া আর কী ভাবে বাঁচব আমরা?
যে কষ্ট মেয়েটি পেয়ে চলে গেল, তা যেন আর কোনও দিনও কেউ না পায়। কিন্তু ওর সেই কষ্টটা যাতে বৃথা না যায়, সেই চেষ্টাটুকু তো আমাদের করে যেতেই হবে। মেয়েটি তো আজ আমাদের কাছে জ্বলন্ত মশাল। আর সেই আগুনটাকে আমরা নিভতে দিতে পারি না। ওর জ্বালিয়ে যাওয়া আগুন যেন আরও দূরে, আরও দাউ দাউ করে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।