Jatra Para in Present Times

যাত্রার এ কাল থেকে সে কাল, পালাবদলে কতটা বদল পালায়?

হয়তো আজও পুজোর সন্ধ্যায় মানুষ খুঁজে ফেরেন ভাল লাগা গল্প, দাপুটে অভিনয়।

Advertisement

তিষ্য দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:১৮
Share:

আশ্বিন মাসের শিশির মাখা সকালে যখন ভিজে চুলে কুমোরটুলির ঘাট বেয়ে উঠে আসেন কল্যাণী, হয়তো শোভাবাজার রাজবাড়িতে নহবতের আলাপ শুরু হয়ে যায় তখন। কথিত আছে, শহরে এসে মা দুর্গা জলসা শোনেন শোভাবাজারের রাজবাড়িতে। আর সেই রাজবাড়িতেই আধুনিক হয়ে উঠল যাত্রাপালা-- প্রবোধবন্ধু অধিকারীর হাত ধরে। ধীরে ধীরে হ্যাজাকের আলোর পাঠ চুকিয়ে ক্ল্যারিওনেট, হারমোনিয়ামের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রার আসরে ঢুকলো স্প্যানিশ গিটার, সিন্থেসাইজার। সময়টা তখন এই আশি নব্বইয়ের দশক। যে কাহিনি বেরিয়ে এল রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীতকার মুরারি রায়চৌধুরীর কথায়, নাটকের গান জীবন্ত হয়ে ওঠে যার হাতের ছোঁয়ায়।

Advertisement

থিয়েটার ওয়ার্কশপের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা, নির্দেশক-নাট্যকার অশোক মুখোপাধ্যায়ের জন্ম খাস চিৎপুর পাড়ার কাছেই, শোভাবাজারে। অতএব দেওয়ালে দেওয়ালে যাত্রার পোস্টার দেখেই বেড়ে ওঠা। স্মৃতির পাতা উল্টালে তাঁর মনে পড়ে যায় পুজোর সময়ে বাজারের মধ্যে উড়ে যাত্রার কথা। দু'দিন উড়ে যাত্রা আর এক দিন বাঙালিদের পালা। কুশীলব বাজারের ব্যবসায়ীরাই- সকালে যাদের হাতে লেগে থাকে মাছের আঁশ, পেঁয়াজের খোসা। অশোকবাবুর মতে, সুরেলা অথচ উচ্চকিত অভিনয়, লাইভ অপেরা, বিবেকের গান আর সখীর দলের নাচ-- সব মিলেই সম্পূর্ণতা পায় যাত্রাপালা। নাট্যকার-নির্দেশক দেবাশিস রায়ের স্মৃতি আবার ছোটবেলায় দেখা মদনপুরের অ্যামেচার যাত্রাপালা, নাচে-গানে সব মিলিয়ে এক ভরপুর বিনোদন।

একটু অন্য ধরনের যাত্রার গল্প শোনালেন নির্দেশক-অভিনেতা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ছোটবেলা আমোদিত হয়ে আছে রামযাত্রার স্মৃতিতে-- সকালে ঝাড়ু হাতে রাস্তা পরিষ্কার করছেন যিনি, সন্ধেবেলা তিনিই লক্ষ্মণের বেশে। ন্যূনতম আয়োজনে পাড়ায় পাড়ায় রামায়ণের পালা। চোখের জলে ভেসে গায়ের গয়না খুলে দিচ্ছেন পাড়ার বউরা। আবার মাসখানেক পরে ব্যতিব্যস্ত পাড়ার লোকই কার্যত ঝেঁটিয়ে বিদেয় করছে রামযাত্রার দলকে। কৈশোর পেরিয়ে তিনি মজেছেন শিবদাস মুখার্জির 'চেঙ্গিস খাঁ'-এ, অথবা স্বপনকুমারের 'রিক্তা'- তে।

Advertisement

যাত্রার স্বর্ণযুগের অন্যতম জ্যোতিষ্ক নটসম্রাট স্বপনকুমার। অথচ ছবি বিশ্বাসের অন্ধ ভক্ত স্বপনকুমার চাননি তার ভাগ্নে সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় জগতে আসুন। পড়াশোনার জগতের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই সময়ে যাত্রা ছিল সম্পূর্ণ সাহিত্য ও অভিনয় নির্ভর। 'দেনাপাওনা', 'বাঘিনী', 'নিশিপদ্ম', 'স্ত্রী', 'সপ্তপদী'-- সাহিত্যকে যোগ্য সঙ্গত দিত স্বপনকুমারের সাবলীল এবং সহজ অভিনয়।

উৎপল দত্ত ও স্বপনকুমারের যোগ্য উত্তরসূরি অভিনেতা নির্দেশক সন্তু মুখোপাধ্যায়। তিনিও চূড়ান্ত গুরুত্ব দিতেন অভিনয় ও স্বরক্ষেপনে। "কিন্তু সেই যুগে যে মৌলিক নাটকের নাম হত তামসী, আজ সেখানে শাশুড়ি বৌমার চুলোচুলির গল্প,"- সখেদে বললেন সুরজিৎ, তিন দশকের অভিনয় জীবন পার করেও যিনি আজ ডাক পান নাট্য অ্যাকাডেমির পরিবর্তে যাত্রা অ্যাকাডেমিতে, স্রেফ স্বপনকুমারের ভাগ্নে হিসেবে। "লোকে আমাকে যাত্রাওয়ালা বানাতে পারলে বেশি খুশি হয়,"- আক্ষেপটা স্পষ্ট তাঁর গলায়।

যাত্রা পেরিয়েছে অনেকটা পথ। পাল্টেছে তার ধরনও। "এখনকার যাত্রায় রুচির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, তবে তার সূত্রপাত কিন্তু সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই। যখন থেকে যাত্রা হয়ে উঠলো সিনেমার এক্সটেনশন মাত্র। আজ 'জওয়ান'-এর সঙ্গে যাত্রার খুব একটা পার্থক্য পাওয়া মুশকিল। পুরোটাই হয়েছে সময়ের হাত ধরে," বলছিলেন অভিনেতা শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়। একই মত অভিনেতা কৌশিক করেরও- "আজ শুধু যাত্রাটাই আছে, পালাটা পাল্টে গেছে বিলকুল।"

নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের পুত্র সাহিত্যিক বিমোচন ভট্টাচার্য, সাংস্কৃতিক কর্মী আশিস দাশগুপ্ত থেকে শিক্ষক সাহিত্যিক নাট্যকর্মী অনীত রায়-- প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেন, সাহিত্যনির্ভর গল্পের কদর আজও আছে। তাই হয়তো আজও পুজোর সন্ধ্যায় মানুষ খুঁজে ফেরেন ভাল লাগা গল্প, দাপুটে অভিনয়। পুজোর সময় ঘনিয়ে এলে কি মা দুর্গাও এক বার ঢুঁ মেরে যান চিৎপুর পাড়ায়- সরস্বতীর পুত্র কন্যাদের খোঁজে? কে জানে!

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement