ছোটবেলা থেকে শুরু করে এখন অবধি জার্নিটা অনেকটা। পুজোর বিষয়ে অনুভূতি বিভিন্ন সময় বদলে বদলে গিযেছে। যেমন ছোটবেলায় পুজোর মানে ছিল সেজেগুজে পুজো প্যান্ডেলে যাওয়া। পুজোর পাঁচ দিন পাঁচ রকমের জামা পরা। আরও ছোটবেলায় পুজোতে কী কী বাজার হল সেটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করত। বাড়িতে কেউ এলে তাঁকে আগে থেকেই পুজোর জামা দেখাতাম, ‘দেখো’। মানে আত্মীয়স্বজন এলে আরকি।
একটা সময় বুঝতে পারলাম, পুজোয় কেনাকাটা করার উছ্বাসটা চলে গিয়েছে। তার কারণ, পৃথিবী এত বদলে গিয়েছে যে আলাদা করে শুধু পুজোর সময় কিনছি তা না, সব সময়ই কেনাকাটা চলছে। আমাদের ছোটবেলায় ছিল পুজো বা নববর্ষ উপলক্ষে কেনাকাটা। এখন সারা বছরই কিছু না কিছু কেনাকাটা হচ্ছে। এখনই আলমারি খুললে দেখা যাবে যে সাত আটখানা জামা এমনিই পরা হয়নি। ফলত ওই উত্তেজনাটা নেই। শপিংটা আর স্পেশাল নেই। তার পরিবর্তে এখন একটা জিনিস স্পেশাল হয়েছে— যেটার জন্য সারা বছর ধরে তাকিয়ে থাকি। সেটা হচ্ছে, পুজো মানেই ছুটি এবং সে সময় আমরা কলকাতার বাইরে কোথাও চলে যাব। পাশাপাশি আমার এটাও ভাবতে খুব ভাল লাগে যে কলকাতাতে পুজো চলছে। তার কারণ পুজো একটা দারুণ ব্যাপার। এই যে এত জন মানুষ, তাঁরা এত আনন্দ করেন, এত আনন্দময় মুখ, এত রঙিন হয়ে থাকে সব কিছু, শহরটার চেহারাই পুরো বদলে যায়। সাউন্ডস্কেপ থেকে আরম্ভ করে চেহারা— সবটাই। পুজো ব্যাপারটাই ভীষণ কালেক্টিভ, সমষ্টিগত। সব সময় সবটা যে আমার ভাল লাগে তা নয়। এই যে মাইক বাজানো হচ্ছে জোরে, ভাল লাগার কথাও নয়।
সাধারণত পুজোর সময় আমরা শহর থেকে একটু দূরে যাই। কিন্তু এ বার খুব দূরে কোথাও যাব না বলেই ঠিক করেছি। পশ্চিমবঙ্গেরই কোনও একটা গ্রামে পুজো কাটাবো। যেখানে একটা খুব ছোট প্যান্ডেল হবে, হয়তো শাড়ি দিয়ে তৈরি করা, হয়তো প্রতীমার আতিশয্য থাকবে না, দূরে হয়তো একটাই ঢাক বাজবে, একসঙ্গে পাঁচটা ঢাক বাজবে না, কোনও মাইক বাজবে না— এ রকম একটা পুজো দেখতে চাই।
আরও পড়ুন: অষ্টমীর সকালে হালকা তাকানো ছোটবেলায় চলেনি যে তা নয়: সুদীপ্তা
বেড়াতে গেলে আমি আর পোশাক নিয়ে ভাবি না। বেড়াতে গেলে পোশাক হবে ট্র্যাভেল লাইট। ব্যাগে থাকবে খুব কম জামাকাপড়। কারণ বেড়াতে যাওয়াটা একেবারেই অন্য সত্তা, বেড়াতে গিয়ে আমি কী করছি একেবারেই ইম্পর্ট্যান্ট নয়। কারণ কখনই বেড়াতে গিয়ে পুজোর পোশাক পরলে আরাম হবে না। আরামদায়ক পোশাকই পরতে চাইব।
আমাদের ছেলেও নতুন জামার জন্য একেবারেই বায়না করে না। ওকে নতুন জামা পরানো হলে একবার জিজ্ঞেস করে, ‘‘এই জামাটা কি নতুন?’’ আমি ওকে বলি, ‘‘হ্যাঁ, তোমার এই জামাটা নতুন।’’ ছোটবেলার এই ব্যাপারগুলো যেন ওর থাকে। সে জন্য ওর কিছু নতুন জামাকাপড় নিয়ে যাব। আমি চাইলেই নতুন জামা পরতেই পারি। কিন্তু দেখেছি, আমি যে মানুষটা, তার আর নতুন জামা পরলে বেড়ানোটাই হয় না। মানে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম, নদীর ধারে বসে পা দোলালাম, নতুন জামাকাপড়ে সে সব খুব অসুবিধের।
আরও পড়ুন: আমার এ বারের পুজো কাটছে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেই: ঝুলন
পুজোর সময় প্রকৃতি দেখতে খুব ভাল লাগে। সব ঋতুই ভাল লাগে। বর্ষাকাল যেমন ভাল লাগে, শরৎ কালও ভাল লাগে। হেমন্ত তো এখানে খুবই কম সময়ের জন্য আসে। কিন্তু কলকাতার বাইরে যদি যাই, তা হলে কিন্তু বোঝা যায় হেমন্ত কাল বলে কিছু আছে। কলকাতার বাইরে গেলেই কাশফুল দেখা যায়। সাদা সাদা মেঘ তো ছেড়ে যেতেই চায় না। রবীন্দ্র সঙ্গীত না বাজলেও তার কলিগুলো যেন মনে পড়ে বা রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে। ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি, পূজার সময় এল কাছে’— এটাও মনে হয়, আবার ‘শরতের আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’-ও মনে হয়। এগুলো সব প্রকৃতির থেকেই মনের মধ্যে উঠে আসে। প্রকৃতি তো সব কিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সকাল বেলায় শিশির, শিউলি ফুলের গন্ধ— শরৎকালে এগুলো দারুণ। এ বারের পুজোয় এগুলোকেই আরও বেশি করে পেতে চাইছি।
আশ্চর্যজনক ভাবে দশমীর পর আমার খুব মন খারাপও করে। অথচ যখন বোধন হয়, তার সঙ্গে হয়তো আমার কোনও সম্পর্ক থাকে না। পুজো হয়ে গেল, পুষ্পাঞ্জলি দিতে গেল সবাই, সেটার সঙ্গেও আমার কোনও সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু তাও দশমীর দিন আমার মনে হয়, ইস! আবার একটা বছর! এই রহস্য আমি আজও খুঁজে পাই না যে এটা আমার কেন মনে হয়। হতে পারে এটা আমার ছোটবেলার অভ্যেস।