পুজো মানেই ছোট বেলা। আর ছোট বেলা মানের দুষ্টুমি। তাই এমন প্রায় কোনও স্মৃতিই নেই, যার সঙ্গে দুষ্টুমি জড়িয়ে নেই। ব্যান্ডেলে আমাদের প্রায় শ’তিনেক বছরের পুরনো বাড়ি। বিরাট এলাকা জুড়ে সেই বাড়ির এক কোণা থেকে অন্য কোণায় যেতে রাত বিরেতে ভয় লাগত। এক মহল থেকে অন্য মহলে যাওয়ার জন্য ছিল সেতু-বারান্দা। সেখানে সন্ধেবেলা টিমটিমে আলো জ্বলত। পুজোর সময় জ্বলত টুনি-বাল্ব। দুর্গা দালানে সারা বছর রাখা থাকত কাঠামো আর রথের পর থেকেই সাজ সাজ রব।
ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে পড়তাম। পঞ্চমীর পর স্কুল ছুটি পড়ত। এ দিকে তত দিনে দুর্গাদালানে পুরোহিত মশাই আসতে শুরু করেছেন। সকাল বেলা স্নান সেরেই তিনি চণ্ডীপাঠ শুরু করতেন। আমরা তখন স্কুলে যাচ্ছি হয়তো, সত্যি সত্যি সনৎ সিংহের সুরে বলতে হয়, ‘মন বসে কি আর’!
স্কুল থেকে ফিরে জামা-কাপড় না ছেড়েই দৌড় দিতাম কেমন ঠাকুর তৈরি হচ্ছে দেখার জন্য। হাঁক পাড়তেন মা। বকুনি আর পুজোর প্রস্তুতি সব এক সঙ্গে চলত।
একেবারে ছোট বেলায় ভাই বোনেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলত, বিসর্জনের সময় পেঁচা আর ইঁদুর নিয়ে ঘরে রেখে দেওয়ার। অন্য বাহনদের তো আলদা করা যেত না। শুধু লক্ষ্মী-গণেশের বাহনদেরই ঘরে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। আর সেই প্রতিযোগিতায় আমার ক্ষমতার সঙ্গে তুতোভাইয়েরা মোটেও পেরে উঠত না। শেষ পর্যন্ত মা বিরক্ত হয়ে যেতেন। এত বাহন কোথায়ই বা রাখবেন! তাঁরা লক্ষ্মী-গণেশের বাহন বলে কথা, নিয়মিত পুজোআচ্ছার প্রয়োজন।
তারপর ধীরে ধীরে যখন ডানায় পালক গজাতে শুরু করল, তখন আবার পুজোর অন্য মজা। আমাদের বাড়ির পুজোয় আসতেন পাড়ার সকলেই। নিমন্ত্রণ করা হত আত্মীয় বন্ধুদের। সেখানেই তো ধরা পড়েছিল প্রথম প্রেমের রিনরিনে স্বর। অষ্টমীর অঞ্জলি মানেই একটা আলাদা গন্ধ, আলাদা আবেশ।
সকালবেলার স্নান সেরে সোজা দুর্গাদালানে। হাতে ফুল আর মনে দোলাচল নিয়ে শুরু হত মন্ত্রপাঠ। অন্য সকলের চোখ বন্ধ, কিন্তু আমি কখনও চোখ বন্ধ করতাম না। ঠোঁট বিড়বিড় করলেও চোখ খুঁজে বেড়াত সেরা সুন্দরীকে। পেয়েও গিয়েছিলাম তাঁকে। তত দিনে একটা ভাল চাকরিও জুটিয়ে ফেলেছি। কিন্তু কী জানি কেন, তাঁর বাবা রাজি হলেন না। আমিও ভাবলাম আরও বড় হতে হবে। চাকরি ছেড়ে পাড়ি দিলাম মুম্বই। গানের পরিবার আমার, গানকেই প্রথম প্রেম করতে চেয়েছি সব সময়। তবে সেই সব দিন বড় মধুর। ঠাকুমা, ঠাকুরদার ভালবাসা আজও আমার জীবনের সেরা সম্পদ।
অষ্টমী আর নবমীতে আমরা সপরিবারে কলকাতায় আসতাম। একদিন উত্তর, একদিন দক্ষিণ— সারা রাত হেঁটে ঠাকুর দেখতাম। তার পর লাইন দিয়ে রয়্যালে চাপ-বিরিয়ানি খাওয়া, কোনও বার সাবিরের রেজালা। আশির দশক পর্যন্ত এই নিয়ম চলত। এখানে একটা দারুণ মজা হত। অষ্টমীতে তো নিরামিষ খেতে হবে। এ দিকে কলকাতায় ঘোরাফেরা, না খেলে চলবে! তাই আমরা ঠিক করে নিয়ে ছিলাম ওই দিন আমরা ইংরিজি মত মেনে চলব। অর্থাৎ তিথি যতক্ষণই থাকুক না কেন, রাত ১২টা বাজলেই ধরে নেব অষ্টমী শেষ। এবার নবমী, ফলে আমিষ খাওয়াই কর্তব্য।
এখনও সেই আনন্দ প্রায় একই রকম আছে। তবে বহু বারই কলকাতায় থাকা হয় না পুজোয়। কাজের জন্য অনেক সময়ই বাইরে বাইরে থাকতে হয়। গত বছর কিন্তু মোটর বাইকে চড়ে কলকাতার পুজো দেখেছি, একেবারে কলেজ জীবনের মতো। বেশিরভাগ সময়ই হেলমেট খুলিনি মাথা থেকে। সঙ্গে ছিলেন আমার স্ত্রী। আমার বড় মেয়েকেও কলকাতার পুজো দেখাতে চেয়েছি, কারণ দুর্গাপুজো কী তা অন্য কোথাও থাকলে বোঝা যায় না। ছোট মেয়েটা বড্ড ছোট, মাত্র ছ’বছর। ওকে নিয়ে মোটর বাইকে চড়ে ঘুরতে ভয় পাই। আর একটু বড় হলেই ওকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরবো কলকাতায়। এরকমই ভেবে রেখেছি।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব ' ফিচারের একটি অংশ।