সে অবাঙালি। হাতে কাচের চুড়ি। ষষ্ঠীতে কেনা শাড়ি জড়িয়েছে। আঁচল আর ব্লাউজ আগে-পরে হচ্ছে। হুঁশ নেই। কানে ঝুমকোটো শুধু দুলছে আর সে অষ্টমীর অঞ্জলি দিচ্ছে!
ইন্দু। কলেজে পাশ করে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে আমাদের প্রেম। দুর্গা পুজোর কিছুই জানতো না ইন্দু! হাতে হাত রেখে একসঙ্গে অঞ্জলি দিয়েছিলাম আমরা। ওই যেমন বিয়েতে খই ফেলে একসঙ্গে। ওকে কলকাতায় আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম দুর্গা পুজো দেখাতে। ও পুজো দেখত বিস্ময় চোখে আর আমি ওকে দেখতাম। মনে হতো বিশ্বপৃথিবী আমার হাতের মুঠোয়!
আজ দুর্গা পুজোও নেই। ইন্দুও নেই। কিন্তু আমার একটানা ১৮ ঘণ্টার কাজের ফাঁকে নিউ জার্সির বাড়ির কাচ ঠিকরে রোদ এসে পড়ে, তখন ইন্দুর চুড়ির কথা মনে পড়ে যায়। রোদ সে দিনও ছিল! ওর চুড়িতে ঠিকরে পড়ছিল।
পুজোয় এক অবাঙালি মেয়েকে পুজো করতে দেখা... এটাই আমার চিরকালের দুর্গা পুজো।
আরও পড়ুন: অতিমারির পুজোয় গঙ্গা বাঁচানোর ডাক ক্যামডেনের মণ্ডপে
আমাদের পুজোতে ছুটি থাকে না। এখানে দুর্গা পুজো কী, আমেরিকানরা প্রায় কেউ জানেই না। আমেরিকার ছোট ছোট শহর, উপশহরে যে সব বাঙালি থাকে, যেমন ধরুন সাউথ ডাকোটা, নিউ মেক্সিকো, বা মিসিসিপির মতো জায়গায়, তারা অনেক সময়ে দুর্গাপুজোতে কিছুই করতে পারে না। অনেক সময়ে পুজোর চার দিন কোথা দিয়ে কেটে যায় শুধু ভেবে যে- আজ সপ্তমী, কাল অষ্টমী, তার পর নবমী, তার পর বিজয়া। আজ ভাসান হচ্ছে। এখন আমেরিকায়, নিউ ইয়র্কের ছোট্ট শহর সিরাকিউজে নয়তো অলবানিতে সকাল এগারোটা। আমরা কেউ অফিসে বসে আছি। হয়তো কলেজে পড়াচ্ছি। হয়তো দোকানে কেউ কাজ করছি। দেশে পুজো শেষ।
২০০৮-এ প্রথম নিউ জার্সির দুর্গা পুজোয় যাই আমি। এখানে তো উইকএন্ডে পুজো হয়। হ্যাঁ, ওখানেও চুড়ি ছিল, তবে সোনার! চার দিকে দামি গয়না, শাড়ি, বাড়ি, গাড়ি আর কার ছেলে কত ভাল পড়াশোনায়- সেই আলোচনা। বাইরে থেকে ভীষণ রুচিশীল আভিজাত্যের ঝলক, অথচ শ্রেয়া ঘোষাল বা ও রকম কোনও সেলিব্রিটি দেখলেই কে প্রথম সারিতে বসবে সেই নিয়ে ঠান্ডা লড়াই। শিকাগোর দুর্গা পুজোয় গিয়ে তো আরও চমকে গেলাম! আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের আগে দেখি অ্যামেরিকার ন্যাশনাল অ্যান্থেম বাজানো হল! এখানকার দুর্গা পুজো এত বছর ধরে দেখতে দেখতে মনে হয়, এটা আর বাঙালি নেই, 'আমেরিকান দুর্গা পুজো' হয়ে গেছে। আজ এই দেশে থাকলেও হৃদয়ের সেই টান অনুভব করি না। যে টানে পুজোর শিউলি ফুলের মধ্যে মায়ের গানের গন্ধ পাই, "আমার নয়ন ভুলানো এলে/ আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে।"
নিউ জার্সির 'কল্লোল'-এর পুজোয় এ বার ২৫ জন করে প্যান্ডেলে ঢোকার নির্দেশ এসেছে।
ছোটবেলায় নেতাজি নগরের বাড়িতে ষষ্ঠীর দিন একসঙ্গে লুচি খাওয়া হত। আমার দিদুনের বাড়িও কাছেই ছিল। মামা আসত মুম্বই থেকে। বেশ একটা পরিবার পরিবার গন্ধ লেগে থাকত সেই দুর্গা পুজোর দিনগুলোতে। বাবার বর্ধমানের বাড়ি যেতাম, সপ্তমী থেকে নবমী সেখানেই। তার পরে বিজয়া।
বড় হতে শুরু করলাম। পুজো ভাল লাগত না আর। পুজো মানেই আত্মীয়দের জড়ো হওয়া, আর ভাই-বোনদের লড়িয়ে দেওয়া। কে কার থেকে পড়াশোনায় ভাল। কার কত টাকা..
আরও পড়ুন: লুপ্তপ্রায় পটচিত্রকে জীবনদানের প্রয়াস বেঙ্গালুরুর পুজোয়
তবে এই আঠেরো পেরিয়ে চাকরির জগতে এসে দুর্গা পুজোকে বড় করে দেখতে শিখলাম। নিউ জার্সির লাল পাতা ঝরে পড়ার মধ্যে যে সজীবতা, এই পুজোও তাই। কলকাতার রাস্তার ছবিটা হঠাৎ নিউ ইয়র্কের সন্ধে বেলা একলা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সামনে এসে দাঁড়ায়। একদল বাচ্চা নতুন জামা পড়ে বেলুন ওড়ায় আজও। তখন হয়তো তার বাবা-মা এগ রোলের দোকানে! আইসক্রিম, ফুচকা, ভেলপুরির স্টলে উপচে পড়া ভিড়। নতুন জুতোর ফোস্কা। সমাজের সব স্তরের মানুষের নিজের মতো করে আনন্দে মেতে ওঠার কার্নিভালই তো দুর্গা পুজো! অর্থনৈতিক বৈষম্যের সব পথ মুছে দেওয়া কিছু ঝলমলে দিন। একে তো দূরে থেকেও দূরে রাখতে পারি না। এই সমতার ছবি কেন দীর্ঘস্থায়ী নয়? সত্যি যদি হত এমন, আহা!
এ বারে কোভিড ঘেরা দুর্গা পুজো। নিউ জার্সির 'কল্লোল'-এর পুজোয় এ বার ২৫ জন করে প্যান্ডেলে ঢোকার নির্দেশ এসেছে। পুলিশ থাকবে নিরাপত্তার জন্য। সিঙ্গাপুরে শুনলাম এ বার পুজোই হচ্ছে না। আমেরিকায় সেকেন্ড ওয়েভ আসছে করোনার। তা-ও নিউ জার্সিতে দুর্গা পুজো হবেই। অনেক টাকা আসে যে এই পুজোর মাধ্যমে!
আরও পড়ুন: মিলেমিশে উৎসবে মাতা হচ্ছে না সিডনির
আজ ২০ বছর আমেরিকায় থেকে ধূপ আর আরতির শব্দ নিয়ে ফেরা, প্রথম প্রেমের ম্যাডক্স স্কোয়ারে চুমু খাওয়া সেই আমি দুর্গা পুজোকে অন্যের ভাললাগার মধ্যে দিয়ে দেখতে চাই। একটা বাচ্চার হাসি আজ অনেক বেশি টানে আমায়! আমার এই পরিবর্তন দুর্গা পুজোই এনে দিয়েছে! আসুক না এমন পৃথিবী, যেখানে দশমীতে মায়ের বিসর্জনের পরেই একাদশীর সকালে আবার কোনও এক নারীর ধর্ষণের খবর আর যেন আমাদের পড়তে না হয়!