বিশ্বকর্মার ঘুড়ি আকাশে উড়লে বাংলায় পুজো পুজো ভাবের শুরু। পুজোর আমেজ তৈরিতে আমরা দক্ষিণের বাঙালিরা কিন্তু বঙ্গবাসীদের টেক্কা দিয়ে দিয়েছি!
আমাদের পুজো ভাবের শুরু তিন মাস আগে থেকে। বলতে গেলে, চেন্নাইয়ে আমাদের পুজোটাই তিন মাসের! কী রকম? আরও অনেক প্রবাসের পুজোর মতো আমরা কুমারটুলিতে প্রতিমার বায়না করিয়ে আগাম ডেলিভারি করাই না। চেন্নাইয়ের টি নগরে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনেই আমরা একটা মিনি কুমারটুলি তৈরি করে ফেলেছি! পুজোর তিন মাস আগে জীবন পালের টিম এসে এখানে ঘাঁটি গাড়ে। চেন্নাইয়ে গোটা পনেরো দুর্গাপুজো হয়। তাদের সকলের প্রতিমা তৈরি হয় আমাদের এখানেই। সেই সঙ্গে কালী, জগদ্ধাত্রী, সরস্বতী সব। আমাদের স্টোর রুমে রাখা থাকে সে সব প্রতিমা।
প্রতিমা শিল্পীর টিম চলে এল মানে শুরু হয়ে গেল আমাদেরও পুজোর অনুষ্ঠানের রিহার্সাল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটকের মহলা। তখন থেকেই আমাদের পুজো শুরু। টিভির রিয়্যালিটি শো-য় চোখ রেখে সঙ্গীত প্রতিভাকে এখানকার মঞ্চে নিয়ে আসা, কলকাতা থেকে নাটকের দল ‘বুক’ করা— সে সব তো আছেই। আমাদের অভিনয়ের নাটকও থাকে। গোটা পুজো জুড়ে দল বেঁধে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশিই চলে আমাদের লাগাতার অনুষ্ঠান। আমাদের সম্পাদক সৌম্য গুহ ঠাকুরতা, সভাপতি অমিত বিশ্বাসেরা এই আয়োজনেই ব্যস্ত।
কলকাতার বাঙালির ভোজনরসিক বলে নাম বা বদনাম আছে। কলকাতায় না থেকেও আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার কিন্তু বেশ এলাহি। পুজোর প্রতিটা দিন দেড় থেকে দু’হাজার লোকের পাত পড়ে এখানে। দিনের বেলায় নিরামিষ। বাঙালিদের পাশাপাশি স্থানীয় তামিল মানুষ, কর্মরত অন্যান্য প্রদেশের লোকও এক পংক্তিতে সামিল হন পুজোর দুপুরে খাওয়ার আসরে। রাতে থাকে আমিষ খানার আয়োজন। আর চতুর্থী বা পঞ্চমীতে বাড়ির মহিলারা নানা পদ রেঁধে নিয়ে এসে স্টলে বিক্রি করেন। এই অনুষ্ঠানটার নাম ‘আনন্দমেলা’। ক্রেতা ওখানে আমরাই। কিন্তু পুরোটাই নির্মল আনন্দ।
আরও পড়ুন: মরুভূমিতে পদ্ম ফোটে মায়ের আগমনে
পুজোর কয়েক দিনে রান্না করে পরিবেশনের সঙ্গে অবশ্যই থাকে মিষ্টিমুখ। কলকাতা থেকেই কারিগর নিয়ে আসি। এ বার যেমন এসে গিয়েছে ১৪ জনের দল। ওঁরাই রান্না করেন, মিষ্টির হালুই সামলান। পেট-পুজো থাকে জমজমাট!
বিসর্জনটা আমাদের এখানে একেবারে অনন্য। নদীতে ঠাকুর বিসর্জন, গ্রামে বা মফস্সলে পুকুরে ঠাকুর ফেলাও সকলে দেখেছেন। কিন্তু চেন্নাইয়ের বিসর্জন হয় সমুদ্রে এবং সেটা একটা টেকনিক। এত দিনে আমরা সেটা শিখে নিয়েছি। সমুদ্রে ঠাকুর ভাসান দিলেই ঢেউয়ের ধাক্কায় ‘রিবাউন্ড’ হয়ে ফিরে আসে। কাত করে এমন একটা কায়দায় ঠাকুর ফেলতে হয়, যাতে সরাসরি ঢেউয়ের অভিঘাত কম লাগে। স্রোতের ধাক্কায় প্রতিমা সরে সরে যায়, সেই মতো কাত করে জলে ডোবাতে হয়। গোটাটা একটা প্রক্রিয়া রীতিমতো।
আরও পড়ুন: ঘরছাড়ারাই বোঝে, ঘরে ফেরার কী যে আনন্দ!
তবে এটা মেরিনা বিচে হয় না। জনবিরল একটা বিচ পুলিশ বেছে দিয়েছে। পুলিশই আমাদের নিয়ে যায় এবং কড়া নির্দেশ আছে, দিনের আলো পড়ার আগেই ঠাকুরকে সমুদ্রে পড়তে হবে। সেই পর্ব শেষ করে ফিরতে ফিরতেই শুরু হয়ে যায় পরের বছরের পরিকল্পনা!