নিজের পদবি বিশেষণ হয়ে যাওয়ার নিদর্শন ইতিহাসে রয়েছে হাতে গোনা। সেগুলির মধ্যে অন্যতম জ্যাকোমো ক্যাসানোভা। ইটালির ভেনিসের (সে সময় ভেনিস ছিল আলাদা প্রজাতন্ত্র) এই লাইব্রেরিয়ান তথা লেখকের বাকি দিকগুলি চাপা পড়েছে তাঁর প্রণয়ী পরিচয়ের আড়ালে। এহেন ব্যক্তিত্বের এক সহচর ভেনিসের তারভাসিও থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর ভারতের কলকাতায়। হুগলির নদীর তীরেই শূন্য থেকে শুরু করে আবার ফিরে গিয়েছিলেন শূন্যে। তিনি এদুয়ার্দো তিরেত্তা, বা ইংরেজিতে এডওয়ার্ড টিরেট্টা। আমাদের অজান্তেই তিনি জড়িয়ে আছেন বঙ্গজীবনে। তাঁর তৈরি বাজারের মধ্যে দিয়ে। যাকে আমরা চিনি ‘টেরিটি বাজার’ নামে।
সম্ভবত উদ্বাস্তু হয়ে ভাগ্যান্বেষণেই তিরেত্তা পা রেখেছিলেন কলকাতায়। তবে ক্যাসানোভার বক্তব্য অনুযায়ী দুরারোগ্য অসুখে প্রেমিকার মৃত্যু মানতে না পেরে শোকস্তব্ধ তিরেত্তা ভেনিস ছেড়েছিলেন। সওয়ার হয়েছিলেন বাটাভিয়ার জাহাজে। পরবর্তীতে তিনি যে বাংলায় পৌঁছে অর্থবান হয়েছিলেন, সে খবরও পৌঁছেছিল বন্ধু ক্যাসানোভার কাছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের যে নথিতে তাঁর উল্লেখ আছে, সেগুলির মধ্যে একটি ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের। সেখানে বলা হয়েছে, ধনী ব্যবসায়ী তিরেত্তা একটি বাজারের মালিক। ৯ বিঘা ৮ কোটার সেই বাজারের তৎকালীন মূল্য ছিল ২ লক্ষ টাকা! ব্যস্ত বাজারে পাকা দোকানে পসরা সাজিয়ে বসতেন দোকানিরা। আজ থেকে ২৩৩ বছর আগে প্রতি মাসে সেই বাজার থেকে ভাড়াবাবদ তিরেত্তার উপার্জন ছিল ৩ হাজার ৬০০ টাকা।
পেশায় তিরেত্তা ছিলেন স্থপতি। আঠেরো শতকে সে সময় কলকাতা সবে ডালপালা মেলছে ব্রিটিশ শাসনে। ভাগ্য ফেরাতে আসা ইউরোপীয়দের খুব একটা নিরাশ করত না এই জনপদ। নিজেদের প্রয়োজনে কলকাতাকে সাজাচ্ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের কাছে কাজ পেলেন তিরেত্তা। প্রথমে তিনি নতুন শহরের মানচিত্র আঁকতেন। তার পর বহাল হন ‘সুপারন্টিন্ডেন্ট অব স্ট্রিটস অ্যান্ড বিল্ডিং’ পদে।
তিরেত্তা কিন্তু ইংরেজি বলতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। জীবনের বেশ কিছুটা পর্ব এই ইটালীয়র কেটেছিল ফ্রান্স এবং জার্মানিতে। তাঁর কথ্য ইংরেজিতে মিশে থাকত ফরাসি, জার্মান, কিছুটা পর্তুগিজ এবং ভারতে আসার পরে অবশ্যই ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষা। পাঁচমিশেলি এই ভাষায় কথা বলেও ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ই্স্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার সিক্কা বেতন পেতে তাঁর অসুবিধে হয়নি।
পাখি পোষার শখ ছিল তিরেত্তার। তাঁর বাজারে পণ্যের মধ্যে বড় জায়গা জুড়ে থাকত পশুপাখি। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে উডের মানচিত্রে সে সময়কার সাহেবপাড়ার শেষে তিরেত্তা বা তেরিত্তি বাজারের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই বর্ধিষ্ণু বাজার শেষ অবধি তাঁর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কেন? সে কারণ নিয়ে ধোয়াঁশা আছে।
বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া তিরেত্তা নাকি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। দেনার দায়ে তাঁর বাজার উঠেছিল লটারির প্রথম পুরস্কার হিসেবে। অর্থাৎ লটারি যিনি জিতবেন, তিনি মালিক হবেন বাজারটির। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ সেই লটারির খবর বার হয়। বলা হয়, পাকাবাড়ির চার দিক ঘিরে আছে বারান্দা। সব দোকান পাকা এবং রাস্তা বাঁধানো। ঠিক মতো দেখভাল করলে বাজার থেকে প্রতি মাসে উপার্জন নাকি ছাপিয়ে যাবে ৩৫০০ টাকাও!
শুধু বাজারই নয়। তিরেত্তার ছিল আরও কিছু সম্পত্তি। সে সময়ে যার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। তিনি কি সত্যি কপর্দকহীন হয়ে পড়েছিলেন? নাকি অন্য কোনও কারণে নিজের সম্পত্তি এবং কারবার গুটিয়ে নিচ্ছিলেন এই দুঁদে ব্যবসায়ী? সে নিয়ে কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে লটারির প্রথম পুরস্কার জিতে বাজারের নতুন মালিক হন চার্লস ওয়েস্টন। তিনিও ছিলেন সাহেব-কলকাতার নামী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান।
বাজার বিকিয়ে গেলেও তিরেত্তার ব্যক্তিগত জীবন কিন্তু বর্ণহীন হল না। বরং, সেখানে নতুন অতিথির আগমন হল। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইটালীয় তিরেত্তা বিয়ে করলেন ফরাসি অ্যাঞ্জেলিকাকে। কিশোরী অ্যাঞ্জেলিকার বাবা ছিলেন ক্যারিয়নের কাউন্ট। রাজনৈতিক কারণে নাকি তাঁকে দেশত্যাগী হতে হয়েছিল। বাংলায় তাঁর বাস ছিল শ্রীরামপুরে। অ্যাঞ্জেলিকার বিয়ের আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন তাঁর কাউন্ট। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাঞ্জেলিকার সঙ্গে প্রথম আলাপ তিরেত্তার। পরের বছরই চতুর্দশী অ্যাঞ্জেলিকাকে বিয়ে করেন তিনি।
আর্থিক বেলা পড়ন্ত হলেও তিরেত্তার জীবনে বিলাসের অভাব হয়নি। তিনি থাকতেন বাদশাহী চালে। সংবাদপত্র জগতের অনন্য পথিকৃৎ জেমস অগাস্টাস হিকির বিবরণ থেকে জানা যায়, কলকাতার প্রখম গ্রীষ্মে তিরেত্তা এক বলডান্সের আসরে নেচেছিলেন খাঁটি ভেলভেটের স্যুট পরে। সেই প্রমোদসভার আয়োজন করা হয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে।
রঙিন চরিত্র তিরেত্তার একটিমাত্র সাদাকালো ছবিকে প্রামাণ্য বলে মান্যতা দেওয়া হয়। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে জেমস গিলরে-এর আঁকা সেই ছবির নাম ‘দ্য বেঙ্গল লেভি’। ছবিতে অষ্টাদশ শতকের অভিজাত সাজে সজ্জিত এক পুরুষকে দেখা যায়, যার নাক লক্ষণীয় ভাবে তির্যক। তিনি-ই নাকি তিরেত্তা। যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি ছিলেন গ্রিক যাজক, ফাদার পার্থানিয়ো।
কিন্তু আচমকাই তিরেত্তার জীবন থেকে আলো ফুরিয়ে যেতে লাগল। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলেন সপ্তদশী অ্যাঞ্জেলিকা। মৃত্যুর মাত্র তিন দিন আগে পালিত হয়েছিল তাঁর তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। তিরেত্তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে প্রথমে সমাহিত করা হয়েছিল বৈঠকখানায় পর্তুগিজদের সমাধিস্থানে। সেই গোরস্থানের নাম ছিল ‘বারেত্তো বেরিয়াল গ্রাউন্ড’।
কিন্তু স্ত্রীর শেষশয্যা নিয়ে খুশি ছিলেন না তিরেত্তো। হতে পারে, ওই গোরস্থানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। অথবা সমাধিক্ষেত্রে বেশি সমাধির ভিড়ে তাঁর স্ত্রীর অন্তিম চিরঘুম তাঁর দেখতে ভাল লাগছিল না। পার্ক স্ট্রিটের ধারে তিনি দেড় বিঘা জমি কিনলেন। তার পর অ্যাঞ্জেলিকার শবাধার এনে স্থাপন করলেন নতুন সমাধিতে। ওয়ারেন হেস্টিংসকে চিঠিতে তিরেত্তা জানিয়েছিলেন, তাঁকে দুঃখজনক পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
কলকাতার বুকে নতুন গোরস্থানের নাম হল ‘তিরেত্তা বেরিয়াল গ্রাউন্ড’। প্রথমে এই সমাধিক্ষেত্রে শুধু ক্যাথলিকদেরই সমাহিত করার নিয়ম ছিল। পরে সেই নিয়ম শিথিল হয় ধীরে ধীরে। প্রিয় অ্যাঞ্জেলিকার সমাধি তিরেত্তা সাজিয়েছিলেন ফলক দিয়ে। সেখানে লাতিন ভাষায় খোদাই করা ছিল তাঁদের ভালবাসার কথা। তিরেত্তা ঘোষণা করেছিলেন, ইউরোপের যে কোনও দেশের মানুষের জন্য এই সমাধিস্থান ব্যবহারযোগ্য।
পরে মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফরাসি কর্মীদেরই এখানে সমাধি দেওয়া হত। তবে অন্যান্য দেশের মানুষের শেষ আশ্রয়ও হয়েছে এই গোরস্থান। বেশ কিছু জেসুইট পাদরিরও সমাধি দেওয়া হয়েছে এখানে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মানচিত্রে এই গোরস্থানকে বলা হয়েছে ‘ফ্রেঞ্চ বেরিয়াল গ্রাউন্ড’।
অনেক গবেষকদের ধারণা, স্ত্রীর মৃত্যুর পরের বছর ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান তিরেত্তা-ও। তিনি সেই বিরল ব্যক্তি, যিনি নিজের নামাঙ্কিত সমাধিস্থানে শেষ শয্যায় স্থান পেয়েছেন। তবে শ্রীপান্থ তাঁর বইয়ে দাবি করেছেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিরেত্তার কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তিনি ভগ্ন হৃদয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর শিশুসন্তানেরও।
ওয়ারেন হেস্টিংসকে চিঠি লিখে তিরেত্তা জানিয়েছিলেন, অ্যাঞ্জেলিকা একটি শিশু রেখে গিয়েছেন। তিরেত্তার এই বক্তব্য থেকে মনে করা হয়, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছিল ওই কিশোরীর। কিন্তু কোনও নথিতে সেই শিশুরও সন্ধান পাওয়া যায় না। কলকাতায় ‘তিরেত্তা’ থেকে যায় শুধু বাজার এবং গোরস্থানে।
বাজার আজও থাকলেও তিরেত্তার গোরস্থানের অস্তিত্ব আজ আর নেই। হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের স্রোতে। তিরেত্তার সেই ঐতিহাসিক বাজার আজ কলকাতার এক ও অদ্বিতীয় টেরিটি বাজার। আজ সেখানে চিনাদের আধিপত্য। সস্তায় সুস্বাদু চিনা খাবারও এই বাজার ও সংলগ্ন এলাকার অন্যতম চুম্বক।