Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ই-পেপার

টেরাকোটার মন্দির থেকে বালুচরীর আঁচল, বাঙালিয়ানার শিকড় ছড়িয়ে প্রাচীন মল্লভূমে

আজকের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে পিছনে ফেলে দেয় বহু জনপদকেই।

অর্পিতা রায়চৌধুরী
বিষ্ণুপুর ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:২৬

বিষ্ণুপুর।

‘মল্ল’ কথার অর্থ সংস্কৃতে মুষ্টিযুদ্ধ। সেখান থেকেই রাঢ়বঙ্গের এক অংশের নাম হয়েছিল মল্লভূম। আবার অনেকের মত, স্থানীয় মল্ল আদিবাসীদের থেকেই এই নামকরণ। সেই ভূমির প্রথম মল্ল শাসক ছিলেন আদি মল্ল। তাঁর জন্মরহস্য এখনও অস্পষ্ট। শোনা যায়, তাঁর রাজপুত পিতা অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীকে জঙ্গলে ফেলে চলে গিয়েছিলেন পুরীতে তীর্থ করতে। অভিজ্ঞানস্বরূপ স্ত্রীর কাছে রেখে গিয়েছিলেন নিজের তলোয়ার এবং বংশপরিচয়।

তার পর জঙ্গলে পুত্রসন্তান প্রসব করে মারা যান সেই রাজপুত নারী। পরে বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় হয় সেই শিশু। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর বিস্মৃত বাবার রেখে যাওয়া অভিজ্ঞান থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাগদি সম্প্রদায় থেকে তাঁর পার্থক্য। স্থানীয় এক ব্রাহ্মণের কাছে বড় হয়ে ওঠে শিশুটি। পরবর্তীতে তিনিই শাসক আদি মল্ল হয়ে স্থাপন করেন মল্ল বংশ এবং গোড়াপত্তন হয় মল্লভূমির। মল্ল শাসকরা ছিলেন বৈষ্ণব। সেই সূত্রে পরে তাঁদের রাজ্যের নাম হয় ‘বিষ্ণুপুর’।

Advertisement



আজকের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে পিছনে ফেলে দেয় বহু জনপদকেই। মল্লরাজাদের তৈরি টেরাকোটার মন্দিরের পাশাপাশি এই জনপদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঘরানা এবং বালুচরীর শিকড়।

একটি ঘাসের উপর একটি শিশিরবিন্দুর মতো কলকাতার কাছেই এই মন্দিরনগরীকে ‘দুই পা ফেলিয়া’ আমাদের অনেকেই দেখে উঠতে পারিনি। দু’দিনের ছুটি থাকলেই দিব্যি ঘুরে নেওয়া যায় প্রাচীন এই শহর।



প্রাচীনত্বের শিকড় বহু দূর অবধি ছড়িয়ে থাকলেও এই মন্দিরনগরীর নির্মাণস্থাপত্যগুলি তাদের স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছিল সপ্তদশ শতকে, মল্লরাজ বীর হাম্বিরের শাসনে। তাঁর তৈরি যে নির্মাণগুলি এখনও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘রাসমঞ্চ’। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বাংলার আটচালার আকারে টেরাকোটার এই মন্দিরের গঠনবৈশিষ্ট্য দেশের অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় বেশ অন্য রকম। প্রাচীন রীতি ছিল, রাসযাত্রার সময় বিষ্ণুপুরের সব মন্দির এবং অভিজাত বনেদি পরিবার থেকে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ এখানে আনা হত। ১৯৩২ সাল অবধি এই রীতি পালিত হত। এখন সুদৃশ্য বাগানের মধ্যে রাসমঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে অতীতের সাক্ষী হয়ে।

রাসমঞ্চের কাছেই ‘জোড়বাংলা’ মন্দির। ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা রঘুনাথ সিংহ দেব দ্বিতীয় এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন গ্রামবাংলার দু’টি আটচালার ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে টেরাকোটার কাজ মনে করিয়ে দেয় বাংলার চালচিত্রকে। রাজা রঘুনাথের তৈরি ‘পঞ্চরত্ন মন্দিরও’ ইতিহাসের আর এক অপরূপ নিদর্শন।



বিষ্ণুপুরের সব মন্দিরই বিখ্যাত টেরাকোটার কারুকাজের জন্য। ব্যতিক্রম নয় মদনমোহনের মন্দিরও। ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এই দেবালয়ের গায়ে খোদাই করা আছে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের নানা কাহিনি। শহরের অসংখ্য মন্দিরের মধ্যে দর্শনীয় বাকি মন্দিরগুলি হল লালজি মন্দির, রাধাশ্যাম মন্দির, নন্দলাল মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির এবং জোড় মন্দির। প্রায় কোনও মন্দিরেই এখন আর পুজো হয় না। তবে ইতিহাস এবং নির্মাণশিল্পের আকর হিসেবে প্রত্যেকটি অনন্য। বাংলার মন্দির নির্মাণ ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ‘একরত্ন’। এখানে রত্ন হল মন্দিরের শীর্ষ বা চূড়া। বিষ্ণুপুরের বেশ কিছু মন্দিরের একটি করে চূড়া। ফলে সেগুলি সব ‘একরত্ন’ মন্দির।

মন্দিরের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরের অন্যতম আকর্ষণ দলমাদল কামান। কোনও কোনও ইতিহাসবিদের মতে, রাজা বীর হাম্বিরের সময়ে তৈরি করানো হয়েছিল এই কামান। আবার কোনও কোনও গবেষকের মত, ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে রাজা গোপাল সিংহের সমসাময়িক এই কামান। জগন্নাথ কর্মকারের তৈরি এই কামানের গোলায় ভর করে মরাঠা আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন মল্লযোদ্ধারা। খোলা আকাশের নীচে কয়েকশো বছর ধরে থেকেও এতে কোনও মরচে ধরেনি। ভক্তিরসের সঙ্গে বীররসের প্রতীক মল্লযোদ্ধাদের এই কামান।



সারাদিন ধরে বিষ্ণুপুর শহরের এই নিদর্শন দেখার পরে কিছুটা সময় রাখুন কেনাকাটার জন্যেও। হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত এই ঐতিহাসিক শহর। বিষ্ণুপুর থেকে ২২ কিমি দূরের পাঁচমুড়া বিখ্যাত টেরাকোটা শিল্পের জন্য। তবে অতদূর না গিয়েও বিষ্ণুপুরে আপনি পেয়ে যাবেন পছন্দসই পোড়ামাটির হস্তশিল্প। কিনতে পারেন বালুচরী শাড়িও। অতীতে বালুচরী শাড়ি তৈরি হত মুর্শিদাবাদের বালুচর গ্রামে। শাড়ি বোনার প্রস্তুতি হিসেবে সুতো মেলে দেওয়া হত নদীর বালুর চরে। তার থেকেই ‘বালুচরী’। শাড়ির রেশমী জমিতে জরির সুতো দিয়ে বোনা হয় পৌরাণিক কাহিনি। ইচ্ছে হলে কিনতে পারেন বালুচরীও।



বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাসের জন্য অনেক লজ এবং হোটেল আছে। মন্দিরনগরী দেখার পরে অনেকেই রাত্রিবাস না করে সেদিনই ফিরে আসেন। তবে আপনার হাতে সময় থাকলে আপনি ঘুরে আসতে পারেন শুশুনিয়া পাহাড়, মুকুটমণিপুর এবং জয়রামবাটিতেও।

কলকাতা থেকে কীভাবে যাবেনঃ

কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব ১৩৮ কিমি। সড়কপথে যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টার কিছু বেশি। যেতে পারেন রেলপথেও। খড়্গপুর-আদ্রা-বাঁকুড়া লাইনে এবং শেওড়াফুলি-বিষ্ণুপুর শাখালাইনে গুরুত্বপূর্ণ জংশন হল বিষ্ণুপুর।

Advertisement