গত শতকের আটের দশকের শুরুর দিক অবধি, কলকাতার স্থায়ী খুচরো বাজারগুলো ছিল এক রকম। তার পর থেকে তারা ক্রমশ বদলাতে আরম্ভ করেছিল। এখন যেমন পাড়ায়-পাড়ায়, অস্থায়ী বাজার, সেগুলো গড়ে ওঠার কারণ ছিল আস্তে আস্তে মানুষের হাতে সময় কমে যাওয়া। আগে মানুষের হাতে বাজারে যাওয়ার মতো, গাঁ থেকে আসা শাকউলি মাসি বা আলু-পেঁয়াজের ব্যাপারীদের সঙ্গে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলার মতো সময় ছিল। গেরস্ত বাঙালি তখন সকালের চা-জলখাবার খেয়ে, লুঙ্গি বা পাজামার উপর ফতুয়া কিংবা পিরান চাপিয়ে, মুখে জর্দা-পান ঠুসে, হাতে দু’তিনখানা চট কিংবা কাপড়ের থলে ঝুলিয়ে দুলকি চালে বাজারের দিকে রওনা দিত। যত সময় গেল, উপার্জনের প্রতিযোগিতা দিন-দিন কঠিন হতে শুরু করল আর সেই সঙ্গে কমতে শুরু করল মানুষের হাতে জমা নিজস্ব সময়। তাই কিছু দূরে হেঁটে গিয়ে বাজার করা ক্রমশই কঠিন হয়ে আসছিল। মোটামুটি ওই সময় থেকেই বাঙালির যৌথ পরিবারগুলো ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে। একটি যৌথ পরিবারের জন্যে যেখানে দৈনিক আড়াই কেজির একটা জ্যান্ত কাতলামাছ লাগত, সেখানে আড়াই বা তিন জনের আলাদা ছোট্ট সংসারে খুব জোর তিনশো গ্রাম মাছ লাগতে শুরু করে। বাঙালির ঘরে-ঘরে রেফ্রিজারেটার ঢুকেছে এরও প্রায় এক দশক পরে, ফলে বাজার থেকে গোটা মাছ কেনাও কমতে শুরু করল।
‘ব্রয়লার’ ছিল অজানা, শহরে ছিল ঝাঁকামুটে আর আন্তরিকতামাখা বাজার
উপার্জনের প্রতিযোগিতা দিন-দিন কঠিন হতে শুরু করল আর সেই সঙ্গে কমতে শুরু করল মানুষের হাতে জমা নিজস্ব সময়।
পাড়ায়-পাড়ায় শুরু হয়ে গেল অন্ধ্রের কাটাপোনা বিক্রির রমরমা। সেই সময় বাজারে মুরগির দোকান থাকত একটি, বড়োজোর দু’টি। সেখানে শুধুমাত্র দিশি মুরগিই পাওয়া যেত। ‘ব্রয়লার’ বলে কোনও শব্দই ছিল না। মুরগির দোকানে দাঁড়িপাল্লা বা তার ছাল ছাড়িয়ে কেটেকুটে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। মুরগি বিক্রি হত পিস হিসেবে। কালে-ভদ্রে বাড়িতে কিনে এনে উঠোনের এক ধারে কেটেকুটে, আলাদা বাসনপত্রে, জনতা স্টোভ জ্বেলে তা রান্না করা হত। হিন্দুবাড়ির হেঁসেলে তার ঢোকার কোনও পারমিশনই ছিল না। যে কোনও স্থায়ী কাঠামোওয়ালা বাজারের সাধারণত দু’টি ভাগ থাকে। মুদিবাজার এবং কাঁচাবাজার। কাঁচাবাজারের আবার তিনটি ভাগ— সবজিবাজার, মাছের বাজার আর ফলের বাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাঁকডাক, দরাদরি আর আকর্ষণ বোধহয় ছিল মাছের বাজারে। গত তিন দশক ধরে কলকাতার সবচেয়ে সুবিধেজনক আর বনেদি জায়গাগুলো থেকে বাঙালিরা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছেন গ্রাম বা মফস্সলের দিকে। তাঁদের দুশো-আড়াইশো বছরের পুরনো শরিকি বাড়িগুলো ভেঙে গিয়ে তার জায়গায় তৈরি হয়েছে বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ি। দু’কামরার ফ্ল্যাটবাড়ির আকাশ-ছোঁয়া দাম দিতে না পেরে, নিজের ভাগের টাকাটুকু নিয়ে তাঁরা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন মফস্সলে। আর তাদের পৈতৃক ভিটেয় ফ্ল্যাট কিনে উঠে এসেছেন একের পর এক উচ্চবিত্ত অবাঙালিরা— খাদ্যভ্যাসের দিক থেকে যাঁরা প্রধানত নিরামিষভোজী। ফলে ওই সব জায়গার পুরনো স্থায়ী বাজারের মাছের দোকানগুলো একটি একটি করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও আবার মাছবিক্রেতাই দিয়েছেন ফল বা সবজির দোকান। তবে ক্রমে মানুষের পছন্দের বাজার হয়ে উঠেছে শপিং মল।
কারণ সেখানে যাওয়ার কোনও স্থির সময় নেই। ভরদুপুরে বা রাত সাড়ে ৯টাতেও সেগুলো উজ্জ্বল সাদা আলোয় ফটফট করে।
‘মল’এ কিন্তু কোনও কিছুই জ্যান্ত পাওয়া যায় না। ফল, শাকসবজি, মাছ— সবকিছুই বরফের মতো ঠান্ডা। প্রাণহীন। সেখানে শাক-সবজির গায়ে হাত-বুলিয়ে, টিপে, শুঁকে বা খুঁটে দেখার কোনও উপায় নেই। কেনাকাটার সময় ব্যাপারীদের সঙ্গে গালগল্প, দর কষাকষি, তাও এখানে অসম্ভব। পর পর কিছুদিন বাজারে না-গেলে শাকউলি মাসি বা চারাপোনা বিক্রেতার মুখ থেকে ভেসে আসা জীবনানন্দের সেই অমোঘ লাইন ‘এতদিন কোথায় ছিলেন ?’— তা ‘মল’-এ গিয়ে শুনতে পাওয়ার কোনও চান্স-ই নেই। ওখানকার সেলসম্যানরা সব যেন রোবটের মতো। আগে বেশি বাজার করলে যে ঝাঁকামুটে দাদারা মাথার ঝাঁকায় করে সমস্ত বাজার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতেন, তাঁরাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। শপিং মল-এর ঝাঁকামুটে দাদার সাহেবি নাম হল ‘হোম ডেলিভারি’। আর সুবিধে, তাকে পুজোর সময় কোনও বকশিসও দিতে হয় না।