খুদিরাম সরকারের সেই আদর্শ ৮৬ বছর পরে আজও পালিত হয়ে আসছে এই ভোজনালয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি উঠে গিয়েছে মেসবাড়ি। কারণ খাবারের চাহিদা এত বাড়ছিল, দু’দিকে তাল সামলানো যাচ্ছিল না। শেষ অবধি মেসবাড়ির ঘরগুলি হয়ে গেল ভাঁড়ার ঘর এবং কর্মীদের থাকার জায়গা। পুরনো সেই রীতি মেনে সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের ম্যানেজার-সহ কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা এখানেই। এখনও এটি ‘ভাড়াবাড়ি’-ই। ভাড়া জমা পড়ে ট্রাস্টি বোর্ডে।
অতিথিসেবার আয়োজনে এ বাড়ি রোজই যজ্ঞিবাড়ি। উনুনে আঁচ পড়ে ভোর চারটের সময়। গ্যাস এবং কয়লার উনুনে মিলিয়ে মিশিয়ে সারা হয় রান্না। কয়লার আঁচের সঙ্গে সঠিক অনুপানে মেশে সঠিক মাপে কাটা কুটনো এবং বাটা মশলার স্বাদ। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী একে একে যোগ হয়েছে স্টেনলেস স্টিলের থালাবাসন, টেবিল চেয়ার এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত খাওয়ার জায়গা। শুধু আদি এবং অকৃত্রিম রয়ে গিয়েছে রান্নার স্বাদ। সে দিকে কোনও আপস করা হয় না। হোটেলের অন্যতন কর্ত্রী দেবযানী সেন জানালেন, ‘‘চিরাচরিত রীতি মেনেই আমরা খাবারের দাম বাড়াতে পারি না। কিন্তু গুণমানের ব্যাপারেও কার্পণ্য করা হয় না। ফলে এই দু’দিক মিলিয়ে আমরা অনলাইন পরিষেবা দিতে পারি না। ফুড অ্যাপে আমরা ছিলাম। কিন্তু সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থে খাবারের দাম বাড়াতে হবে। একজন ক্রেতা আমাদের এখানে এসে খেলে কম দামে খাবেন। আবার তিনিই অনলাইনে একই খাবার বেশি দামে কিনবেন, সে তো হতে পারে না।’’ তাই ফুড অ্যাপ থেকে সরে এসেছেন তাঁরা। তবে বসে খাওয়ার পাশাপাশি খাবার কিনে বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারবেন ক্রেতারা।
এই ভোজনালয়ে এখনও কম্পিউটার ঢোকেনি। হিসেব হয় কাগজে কলমেই। তাই মনে রাখতে হয় চেয়ার নম্বার। কোন চেয়ারের অতিথি কী কী খেযেছেন, দ্রুত লয়ে কাউন্টারে বলতে থাকেন পরিবেশক। দিনের পর দিন একই সুরে বলতে থাকায় মনে হয় যেন ছন্দবদ্ধ কোনও গান।
সেই গান এখনও ভাসছে সিদ্ধেশ্বরীর আবহে। তবে উঠে গিয়েছে মেঝেতে বসে খাওয়ার চল। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির মতো এখানেও আগে খাওয়া হত মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। কাঁসার বাসনে পরিবেশন করা হত খাবার। এখন পুরোটাই চেয়ার-টেবিল। ক্রেতা চাইলে সামান্য মূল্যের বিনিময়ে থালার উপর বিছিয়ে দেওয়া হয় কলাপাতা। তার উপরে সরু চালের ভাতের ঢিপি ভেঙে নারকেল দেওয়া সোনামুগের ডাল। ডালের সঙ্গে নিতেই পারেন পোস্ত অথবা মাছের ডিমের বড়া। থালার পাশে বাটিতে অপেক্ষা করে থাকে ঝুরঝুরে আলুভাজা, ইলিশ, পাবদা, পমফ্রেট-সহ রকমারি মাছ এবং মাংসের পদ। কাঁচা আমের টকমিষ্টি চাটনি। পাশে মাটির ভাঁড়ে জল।
প্রায় নয় দশকের ঐতিহ্য মেনে আজও এই হোটেলে কোনও মেনুকার্ড নেই। দেবযানীর কথায়, ‘‘আমাদের কোনও নির্দিষ্ট দাম নেই। কারণ বাজারে যে দিন যে দামে মাছ পাওয়া যায়, আমাদের হোটেলেও সে দিন সেই অনুযায়ী খাবারের দাম ঠিক করা হয়। মাছ এবং কাঁচা তরিতরকারি আমরা রোজ বাজার থেকে কিনে আনি। তাই এখনও ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়িই আমাদের ভরসা।’’ মানিকতলা বাজার, লেক মার্কেট এবং শিয়ালদহ— এই বাজার থেকেই সাধারণত কেনা হয় সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের কাঁচামাল। এ ছাড়াও রয়েছেন নির্দিষ্ট বিক্রেতারা। যাঁরা হোটেলে জিনিস পৌঁছে দিয়ে যান।
মাছের বিভিন্ন পদ খেতেই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমে ভিড় করেন ভোজনরসিকরা, জানালেন দেবযানী। ভাপা কাতলা, সর্ষে ইলিশ, ভেটকি বা পাবদার ঝোল, চিতল পেটি, পমফ্রেটের ঝাল, তাঁদের ট্রেডমার্ক। চিংড়ি মালাইকারি এখানে রোজকার পদ। নিরাশ হবেন না মাংসপ্রেমীরাও। বাঙালি হেঁসেলের আলু দেওয়া পাঁঠার মাংসের লাল ঝোল এবং চিকেন কষা এই রান্নাঘরে রোজ আসন পাতে। তবে ডিম এখন দিনের বেলা হয় না। আগে রাতে হাঁসের ডিমের কষা হত। এখন সে জায়গায় শুধুই ডিম তরকা। দিনের খাবার কিছু থাকলে পাওয়া যায় রাতের বেলাও। তবে সিদ্ধেশ্বরী খাওয়ার আদর্শ সময় অবশ্যই দুপুরবেলা।
অতিমারি, লকডাউনের ঝড় পেরিয়ে বাঙালির দুপুরগুলিকে আগের মতোই পঞ্চব্যঞ্জনে সাজিয়ে দিতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন দেবযানী ও রীতা সেন। সম্পর্কে বৌদি-ননদ। তাঁরাই এখন হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের কর্ত্রী। দেবযানীর প্রয়াত শ্বশুরমশাই ছিলেন হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা খুদিরাম সেনের দৌহিত্র। তাঁর সময় থেকেই ব্যবসার পর্ব সরকার পরিবার থেকে চলে এসেছে সেন পরিবারে। ২০১৫ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে ব্যবসার হাল ধরেছেন দেবযানী। সঙ্গে আছেন ননদ, রীতা। তাঁদের মেয়েদেরও এই ঐতিহ্য এগিয়ে নেওয়ার জন্য আগ্রহী করে তুলতে চান দু’জনেই। খাওয়ার পাশাপাশি যাতে বাঙালিজীবনে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এবং ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর হাজারি বামুনের হাতাখুন্তির সোহাগ পরশ ফিকে না হয়ে যায়।
(ছবি : হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের ফেসবুক পেজ থেকে)