কলকাতা আমার চিরতরুণী প্রেমিকা। হতে পারে এই শহর বয়সের দিক দিয়ে সুপ্রাচীন। কিন্তু কলকাতার ভিতরে লুকিয়ে আছে আরও অনেক কলকাতা। কবীর সুমনের গানটা এই শহরকে নিয়ে আমারও মনের কথা—‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু/পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু’। কলকাতাকে ছেড়ে গেলেও কলকাতা কিন্তু আমাকে ছেড়ে যায় না। কারণ এই শহরের একটা নিজস্ব স্পিরিট আছে। ভারতের আরও চারটে শহরে আমি থেকেছি। কিন্তু কোথাও এই স্পিরিট খুঁজে পাইনি। এই স্পিরিটের জন্যই আমি ফেলুদাকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘ফেলুদা: ৫০ ইয়ার্স অব রে-স ডিটেক্টিভ’ তৈরি করতে পেরেছিলাম। যা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে।
কলকাতা এখনও যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে যায়নি। কলকাতার মানুষ এখনও অবসর খুঁজে বার করতে চায়। খুঁজে বার করেও। সেই অবসরটুকুই কলকাতার সঙ্গে অন্য শহরের পার্থক্য এনে দেয়। তাই বলে কি কলকাতার মানুষের কোনও কাজ নেই? সেটা কখনওই নয়। আজ, গ্লোবাল ভিলেজের যুগে কোনও শহরই অলস হয়ে বসে থাকতে পারে না। কলকাতাও ছুটছে। কিন্তু সেই ছোটা যন্ত্রের মতো নয়। কলকাতার মানুষ উপার্জন করেন। কিন্তু সারাক্ষণ অর্থের পিছনে দৌড়ে যান না।
অনেকে বলেন, মুম্বইয়ের নৈশজীবন কলকাতার থেকে অনেক রঙিন। আমি তো বলি, কলকাতার পুরো জীবনটাই রঙিন। তাই কলকাতাবাসীর আলাদা করে ‘নৈশ’ অভিযানের দরকার হয় না। কারণ এমন কোনও কাজ নেই, যা সে দিনের বেলা করতে পারে না। কাজ-আড্ডা-প্রেম-ল্যাদ খাওয়া সবকিছুর ককটেল সে সকালেই করে নিতে পারে। আলাদা করে রাত নামার অপেক্ষা করতে হয় না। অফিসের কাজের পাহাড়ের ফাঁকে টিফিনের ছোট্ট অবসরও যে কত মধুময় হতে পারে, কলকাতায় না থাকলে টের পাওয়াই যাবে না।
অন্য শহরের থেকে কলকাতার এই যে চরিত্রগত পার্থক্য, এর অন্যতম কারণ কিন্তু ‘সংস্কৃতি’ এবং সেই ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে কলকাতাবাসীর গর্ব। বেশিরভাগ বাঙালি মনে করেv, কলকাতা এবং বাঙালি বাকিদের থেকে সংস্কৃতির দিক দিয়ে অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। এই ধারণা হওয়ার কারণও যথেষ্ট আছে। ইতিহাস বলছে, দেশের অন্য শহরের তুলনায় কলকাতায় সংস্কৃতির অগ্রগতি অনেক বেশি।
পছন্দের রূপরেখা পাল্টে গেলেও আজও বাংলা বই কেনার জন্য বইমেলা আর কলেজস্ট্রিটে ভিড় করেন পাঠক। ঘুম থেকে উঠে বাংলা কাগজ না পড়লে আজও দিনটাই শুরু হয় না অনেকের। ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলে যে কিছু হয়, সেটা অন্য শহর জানেই না। আমি হায়দরাবাদ, মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুতে থেকেছি। কোথাও এগুলো পাইনি।
কলকাতার মতো খাবারও অন্য কোথাও পাব না। সকলে তো রাস্তার খাবারের কথা বলেন। আমি তো বলব একসঙ্গে এত শাকসব্জিও কোথাও দেখা যায় না। শীষপালং আর পুঁইমেটুলি বিক্রি হচ্ছে বাজারে, সেটা দিয়ে রকমারি আমিষ নিরামিষ পদও হাজির হেঁসেলে—এ শুধু আমাদের এখানেই সম্ভব। আসলে আমার মনে হয়, উর্বর ভূমির একটা প্রভাব আছে খাওয়াদাওয়া থেকে সংস্কৃতি সবকিছুর উপরেই পড়ে।
উর্বর ভূমির সন্তান বলেই বাঙালি যে শুধু চাষবাস করে এসেছে, তা তো নয়। বাঙালির রক্তে বাণিজ্যেরও অধিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বাঙালি সেই ধারা থেকে সরে এসেছে। বাঙালির পুঁজির জোর অনেক ক্ষেত্রে কম হতে পারে, কিন্তু তাই বলে সে পরিশ্রমবিমুখ, এই অপবাদ কিন্তু আমি মানতে পারি না। পরিশ্রম থেকে দূরে সরে থাকলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাঙালি এত এগিয়ে যেতে পারত না।
সবকিছুর পরেও কলকাতার একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। সেই ঘরানাটা অনেকটা অভ্যাসের মতো। এই শহরে থাকতে থাকতে সেটাই অভ্যাস হয়ে যায়। আমি তো কলকাতার ‘ডিসকমফর্ট’ ছেড়ে বেশি দিন থাকতেই পারি না। বাইরে গেলে সবথেকে যা মিস করি, তা হল বাংলা হরফ। বাংলায় কথা না বলেও থাকতে পারি। কিন্তু চোখের সামনে বাংলা হরফ নেই—ভাবলেই দমবন্ধ হয়ে আসে। যখন পুণের সিমবায়োসিসে পড়তাম, ওখান থেকে কলকাতা আসার সময় আমরা কয়েক জন বন্ধু ট্রেনে সারারাত প্রায় ঘুমোতামই না। গভীররাতে ট্রেন ঢুকত ঝাড়গ্রাম স্টেশনে। আমরা জেগে থাকতাম। কারণ ওই প্ল্যাটফর্মেই প্রথম স্টেশনের নামটা বাংলা হরফে লেখা চোখে পড়ত। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড, হোর্ডিং—আমার কাছে খুব প্রিয়। বেড়াতে যাওয়ার জন্য পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সবই ভাল। কিন্তু থাকার জন্য কলকাতার মতো কোনও শহর ছাড়া অন্য কোনওকিছুর কথা ভাবতেই পারি না।
আমার কলকাতার ‘নৈশ’ অভিযানের দরকার পড়ে না, তার দিনের বেলাই যথেষ্ট
কলকাতাকে ছেড়ে গেলেও কলকাতা কিন্তু আমাকে ছেড়ে যায় না। কারণ এই শহরের একটা নিজস্ব স্পিরিট আছে।
ফাইল ছবি
Advertisement
Tags:
Advertisement