এ যুগের চাঁদ যদি কাস্তে হতে পারে, তা হলে ভাইরাস এ যুগের ‘অর্জুন’ হলে ক্ষতি কি?
সে ছিল বৃহন্নলা! আরও কত কী যে!
তার ছদ্মবেশ ছিল হরেক রকম।
থাকতে হবে অজ্ঞাতবাসে। আর ছদ্মবেশ লাগবে না?
কিন্তু যে অত বড় যোদ্ধা, সে যে নাচের তালিম দেওয়ার মতো অত ভাল ছদ্মবেশও ধরতে পারে, আর দীর্ঘ দিন ধরে তা ধরে রাখতে পারে, তা তো দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব- অর্জুনই!
ভাইরাসও পারে। ছদ্মবেশ ধরতে তার জুড়ি মেলা ভার! আর সেই ভাইরাস আমাদের খুব একটা অজানা, অচেনা নয়। পরিচিত ‘সুজন-স্বজন’ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ‘ফ্লু’ ভাইরাস। তারা যেমন ওস্তাদ ছদ্মবেশ ধরতে, তেমনই ধুরন্ধর তারা ধোঁকা দিতেও! যদিও তাদের আকার-আকৃতি, চেহারা-চরিত্র খুবই সাদামাটা। সহজ, সরল।
‘ফ্লু’ ভাইরাস দেখতে কেমন। কেমন তার শরীরের ভিতর-বাহির!
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের এই ধোঁকা দেওয়ার ছল-চাতুরিটা আমাদের শরীরের কোষ যে ধরতে পারে না, আর তা কেন ধরতে পারে না, সেটাই ধরে ফেলেছেন এক বাঙালি ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও জেনেটিসিস্ট। ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। সুইৎজারল্যান্ডে, ‘নোভার্টিস ইনস্টিটিউট ফর বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ’-এর প্রেসিডেন্সিয়াল ফেলো সায়েন্টিস্ট।
ইন্দ্রনীলের গবেষণাপত্রটি একেবারে হালে প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স’ জার্নালে। তাঁর অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মান ‘ফাইজার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন ইন্দ্রনীল, সদ্য ফেলে আসা জানুয়ারিতে।
‘ফ্লু’ ভাইরাস কতটা ভয়াবহ, তা বোঝাতে একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। বিশ্বে ফি বছর গড়ে আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা যান ‘ফ্লু’ ভাইরাসের হানাদারিতে। ২০০৯ সালে ‘সোয়াইন ফ্লু’র হানাদারির ঘটনা আমরা কেউই ভুলিনি। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ভারতে ‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১,১৫৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ১,৮৪১ জনের।
ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ‘ফ্লু’ ভাইরাস কতটা ধুরন্ধর, কতটা ধোঁকাবাজ, এ বার সেই গল্পটা একটু বলা যাক।
ওই ভাইরাস যখন আমাদের দেহে ঢোকে বা আমাদের কোনও কোষে শুরু হয় তার হানাদারি, তখন সে খুব সজাগ, সতর্ক থাকে। যাতে আমাদের দেহের কোষের ‘রাডারে’ ধরা না পড়ে তার মতিগতি! তার ফন্দি! ‘রাডার’কে ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই ধুরন্ধর আর ধড়িবাজ ‘ফ্লু’ ভাইরাস যে, যখন সে সবে দেহে ঢুকে কোনও কোষের গায়ে (সারফেস) লেগে থাকে, তখনই সে তার কায়দা-কসরৎ শুরু করে দেয়। বর্জ্য বস্তুর (ওয়েস্ট মেটিরিয়াল) ছদ্মবেশ ধরে লেগে থাকে সেই কোষের গায়ে, যে কোষটিতে সে হানা দেবে বলে ভেবে রেখেছে। আর সেই ছদ্মবেশটি এতটাই নিখুঁত হয় যে, কোষটিও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটিকে ‘বর্জ্য বস্তু’ বলেই ভেবে নেয়!
কী ভাবে হানা দেয় ‘ফ্লু’ ভাইরাস? দেখুন ভিডিও।
কোষের মধ্যে ঢুকে পড়েই ভাইরাসটি তার বাইরের খোল (ক্যাপসিড) আর তার দেহ থেকে বেরনো প্রোটিনগুলো দিয়ে কোষটাকে অল্প অল্প করে খুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু, চট করে সেই কোষটির খুব বড় কিছু ক্ষতি করে না ভাইরাসটি। তা হলে তো কোষের ‘চোখে’ সে ধরা পড়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে। তাই প্রথমে তার ক্যাপসিড আর প্রোটিনগুলো দিয়ে কোষের খুব সামান্যই ক্ষতি করে ভাইরাসটি। ফলে, বাইরে থেকে যে কোনও ভয়ঙ্কর হানাদার শরীরে ঢুকে পড়েছে, তা আমাদের কোষ বুঝতেই পারে না।
পরিবেশ দূষণ কমাতে আমরা যেমন বর্জ্য বস্তুটিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য (রিসাইক্লিং) করে তোলার চেষ্টা করি নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে, তেমনই কোষে ঢুকে পড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটিকে ‘বর্জ্য বস্তু’ ভেবে সেটিকে নষ্ট করে দেওয়ার (ডিগ্রেডেশান) জন্য তখন কোষও নানা রকমের ছোট ছোট যন্ত্রপাতি বানাতে শুরু করে। যেগুলো নানা রকমের প্রোটিন দিয়ে তৈরি। ওই যন্ত্রপাতিগুলো যাকে বলে, একেবারে ঘাড় ধাক্কা দিয়েই কোষ থেকে বের করে দেয় বর্জ্য বস্তুগুলিকে। ওই বর্জ্য নিষ্কাশনের কাজটা অনেক সময় হয় উৎসেচক নিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেও। ধুরন্ধর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তখনই বুঝে ফেলে, মওকা এসে গিয়েছে। কোষের বানানো সেই সব যন্ত্রপাতি দিয়েই ভাইরাসটি তখন তার বাইরের খোলটাকে (‘শেল’ বা, ‘ক্যাপসিড’) ভেঙে ফেলে। আর তা ভেঙে যেতেই ভাইরাসের শরীরের ভেতরে থাকা জেনেটিক মেটিরিয়াল বেরিয়ে এসে কোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকে পড়ে। শুরু হয়ে যায় তার পুরোদস্তুর হানাদারি। কোষ যখন সেটা বুঝতে পারে, তত ক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।
কী ভাবে কোষকে বোকা বানায় ‘ফ্লু’ ভাইরাস? দেখুন ভিডিও।
কার্গিলের যুদ্ধের ঠিক কয়েকটা দিন আগেকার ঘটনার কথা মনে আছে? মেষপালক সেজে সীমান্ত পেরিয়ে কাশ্মীরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তা বুঝতেই পারেনি। যখন পারল, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পাক শত্রুরা অনেকটাই ঢুকে পড়েছে। আর তারা ঢুকে পড়েছে অনেক বেশি সংখ্যায়। এবং হানাদারি চালানোর জন্য কাশ্মীরের কৌশলগত অবস্থানগুলি দখল করে বসে গিয়েছে। ফলে তাদের হঠাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর। বহু ভারতীয় জওয়ানের প্রাণহানি হয়েছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ভারতের।
‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত ইন্দ্রনীলের গবেষণাপত্র।
ধুরন্ধর, ধড়িবাজ ‘ফ্লু’ ভাইরাসের হানাদারিটাও আমাদের দেহে হয় সে ভাবেই। আমাদের শরীরকে ‘ফ্লু’ ভাইরাস চেনে বহু বহু বছর ধরে। এত দিন ধরে আমাদের শরীরে হানা দিতে দিতে কোষ, কলাগুলোর নাড়ি-নক্ষত্র তারা খুব ভাল ভাবে চিনে-বুঝে গিয়েছে। কোষ, কলার ভেতরে কী কী রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, তার সব কিছুর সুলুক সন্ধান জানে ‘ফ্লু’ ভাইরাস। তাই তারা যে কোষগুলোতে হানা দেবে বলে ভাবে, তাদের সঙ্গে ‘ছদ্মবেশে’ গোড়া থেকে এমন ব্যবহার করতে শুরু করে, যেন কোষগুলো তাদের শয়তানিটা বুঝতে না পারে! আর সেটাই হয়। আক্রান্ত কোষগুলো ‘ভালমানুষির মোড়কে ঢাকা’ ভাইরাসের শয়তানিটা বুঝতে পারে না। বরং ভাইরাসটাকে কোষগুলো তাদের ‘আপন জন’ ভেবে নেয়! আর সেটাই হয়ে যায় কোষগুলোর বড় ভুল। এটাকে বলে ‘ট্রোজান হর্স হানাদারি’। মানে, ধোঁকাবাজির একটা সাজানো গোছানো বৈজ্ঞানিক নাম।
‘ফাইজার অ্যাওয়ার্ড’ হাতে ইন্দ্রনীল।
উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের ছেলে ইন্দ্রনীল স্কটিশ চার্চ কলেজ আর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এম-টেক করেছিলেন আইআইটি কানপুর থেকে। পরে তাঁর গবেষণা জুরিখে, সুইস ফেডারাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আরি হেলেনিয়াসের অধীনে।
ইন্দ্রনীলের এই গবেষণার অভিনবত্বটা কোথায়?
ইন্দ্রনীলবাবুর কথায়, ‘‘আমরা এই প্রথম প্রমাণ করতে পেরেছি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আমাদের কোষে হানাদারি শুরুর প্রাক মূহুর্তে তার বাইরের খোলটাকে ভেঙে ফেলে (যাকে বলে, ‘আনকোটিং’)। সেই প্রক্রিয়াটাকে সাহায্য করে আমাদের শরীরেরই কিছু জিন। বর্জ্য পদার্থ সরিয়ে ফেলার জন্য কোষ যে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ওই জিনই। মানে, ‘ঘর শত্রু জিন’ আমাদের শরীরেই রয়েছে। যাদের মধ্যে একেবারে ‘বিভীষণ’টি হল- ‘এইচডিএসি-সিক্স’ বা ‘এইচড্যাক-সিক্স’। আর যে হেতু আমাদের কোষগুলোর সঙ্গে বহু বহু বছরের পরিচিতি রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের, তাই ওই ভাইরাস ভাল ভাবেই জানে, কোষে হানাদারি চালানোর জন্য সে যেমন কোষেরই বানানো যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করতে পারবে, তেমনই তার বাইরের খোলা ভেঙে ফেলার জন্য পাবে ওই ‘এইচডিএসি-সিক্স’ জিনের সাহায্য-সহায়তা। যা কি না বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য কোষের বানানো যন্ত্রপাতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, ওই জিনগুলো না থাকলে কোষের ‘ওয়েস্ট ডিজপোজাল’-এর কাজকর্মে তেমন কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। কারণ, ‘এইচডিএসি-সিক্স’ জিনের দায়িত্বের ব্যাটনটা তখন আরেকটি জিন নিয়ে নেয় তার কাঁধে। আর সেই জিনটা কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বাইরের খোলটাকে ভাঙার ব্যাপারে আদৌ মদত দেয় না। ফলে, ‘এইচডিএসি-সিক্স’ জিনটিকে শরীরে কোনও ভাবে নিষ্ক্রিয় (ইনঅ্যাক্টিভ) করে দিতে পারলেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ধোঁকা দেওয়ার যাবতীয় ছল-চাতুরিকেই ভোঁতা করে দেওয়া যাবে। আর ওষুধ ব্যবহার করে যে সেটা সাময়িক ভাবে করাও যায়, আমাদের গবেষণায় আমরা সেটাও দেখিয়েছি।’’
ইন্দ্রনীলকে অভিনন্দন বার্তা বিজ্ঞানী হেলেনিয়াসের।
যদিও ‘এইচড্যাক-সিক্স’ জিনটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কাজটা খুব সহজ নয়। তার অনেক হ্যাপা রয়েছে। সেগুলো কী কী?
ইন্দ্রনীল জানাচ্ছেন, ‘‘এইচড্যাক-সিক্স’ ছাড়াও আমাদের শরীরে আরও কিছু জিন রয়েছে, যেগুলো কোষে বর্জ্য নিষ্কাশনের যন্ত্রপাতিগুলোকে তৈরি ও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু, এইচড্যাক-সিক্স জিনটি না থাকলে বা কোনও ভাবে সেটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হলে, ওই জিনগুলো আর কাজ করতে পারে না। তারা অকেজো, ‘অচল আধুলি’ হয়ে পড়ে। বর্জ্য নিষ্কাশনের যন্ত্রপাতি বানাতে তাই এইচড্যাক-সিক্স জিনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
ফ্লু ভাইরাস ধুরন্ধর এই কারণেই যে, সে আমাদের এই অসহায়তাটা বোঝে। কিন্তু, তার পরেও যে ফ্লু ভাইরাসকে বোকা বানিয়ে দশ গোল মারা যায়, ইন্দ্রনীল সেটাই প্রমাণ করেছেন তাঁর গবেষণায়।
সেটা কী রকম?
হলদেটে সবুজ আবরণটাই ভাইরাসের খোল বা ‘ক্যাপসিড’।
ইন্দ্রনীলের ব্যখ্যায়, ‘‘প্রত্যেকটি কোষ থেকে ‘এইচড্যাক-সিক্স’ জিনকে ছেঁটে ফেলা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ওষুধ ব্যবহার করে ওই জিনটিকে সাময়িক ভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যায়। তখন সেটি কোষে থাকলেও, তার কোনও ভূমিকা থাকে না। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। যাতে কোষের বর্জ্য নিষ্কাশনের যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি হতে না পারে। ওই যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি না হলে, সেগুলোকে ব্যবহার করে ফ্লু ভাইরাসও তার বাইরের খোল বা ‘ক্যাপসিড’ ভাঙতে পারবে না। আর সেটা না ভাঙলে, সংক্রমণের জন্য জরুরি ভাইরাসের জেনেটিক মেটিরিয়ালও কোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকতে পারবে না। এই ভাবেই ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণ রোখা যাবে।’’
ছবি; সুইৎজারল্যান্ডের ‘ফ্রেডরিখ মিশার ইনস্টিটিউট ফর বায়োমেডিক্যাল রিসার্চে’র সৌজন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy