শেখ হাসিনা। — ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশ ছেড়ে প্রথমে ভারতে এসে উঠেছেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধাতস্থ হতে তাঁকে কিছু দিন সময় দেওয়া হয়েছে বলে সর্বদল বৈঠকে জানিয়েছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। হাসিনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী, তা তিনি ভারত সরকারকে জানালে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র।
আপাতত বর্তমানে ভারতে গোপন আস্তানায় রয়েছেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কী হতে পারে তাঁর পরবর্তী গন্তব্য, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা চলছে বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে। বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রের দাবি, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেনের কাছে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ চেয়েছেন। তবে এখনও সে দেশের সরকারের তরফে কোনও সবুজ সঙ্কেত মেলেনি। যদিও হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দাবি, তাঁর মা কোনও দেশেই আশ্রয় চাননি।এমতাবস্থায় চর্চায় রাজনৈতিক আশ্রয় (পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম)। কী এই ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’? কী ভাবে পাওয়া যায় তা? কারা রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে পারেন?
সহজে বললে, রাজনৈতিক আশ্রয় হল আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি অধিকার। কোনও দেশ চাইলে ভিন্ন দেশের নাগরিককে নিজের দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারে। এই নিয়ম অনুযায়ী, কেউ যদি রাজনৈতিক মতাদর্শগত কিংবা ধর্মীয় কারণে নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হন, তা হলে অনুমতি সাপেক্ষে অন্য দেশে সুরক্ষামূলক আশ্রয় নিতে পারেন, পেতে পারেন সাময়িক ভাবে সে দেশে প্রবেশ ও বসবাসের অনুমতি।
উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, ধরা যাক জনৈক ব্যক্তি বাংলাদেশি নাগরিক নিজের দেশে নিরাপদ বোধ করছেন না। তিনি যদি ভারতের কাছে আশ্রয় চান এবং নয়াদিল্লি তা অনুমোদন করলে ওই ধরনের আশ্রয়কে বলা হবে রাজনৈতিক আশ্রয়। তবে এ ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কিছু জটিলতাও। মনে রাখা দরকার, কোনও দেশ কাউকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে বাধ্য নয়। নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে এ ধরনের যে কোনও আবেদন প্রত্যাখ্যানেরও অধিকার রয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশেরই হাতে।
কোন পরিস্থিতিতে চাওয়া যাবে রাজনৈতিক আশ্রয়? ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৪(ক) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, নিজ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বা আদর্শগত কারণে কেউ যদি বিপন্ন বোধ করেন, তা হলে নিপীড়ন, প্রাণসংশয় কিংবা গ্রেফতারি এড়াতে অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয়ের আবেদন জানাতে পারেন তিনি। শরণার্থী বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক চুক্তির অন্তর্ভুক্ত সব দেশই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রদানের সব ন্যায্য দাবি মেনে নিতে বাধ্য। তবে সেই আশ্রয়ের দাবিটি আদৌ বৈধ কি না, তা যাচাই করার অধিকার দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের হাতেই। নিজের দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা গুপ্তচরবৃত্তির মতো অভিযোগ থাকলে সেই ব্যক্তির আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজনৈতিক আশ্রয় দু’প্রকার— দেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় এবং কূটনৈতিক আশ্রয়। অতীতেও ভিন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ। যেমন রুশ শাসক জোসেফ স্টালিনের কন্যা স্বেতলানা আলিলুয়েভা ১৯৬৬ সালে ভারতে আশ্রয় না পাওয়ার পর শেষমেশ রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন আমেরিকায়। ইরানের শাসক ‘শাহ’ মহম্মদ রেজা পাহলভি ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে একাধিকবার বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে শেষে থিতু হন মিশরে। ২০১৩ সালে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন আমেরিকান সাইবার গোয়েন্দা আধিকারিক এডওয়ার্ড জোসেফ স্নোডেন।
এক নজরে জেনে নিন কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের নিয়ম কেমন?
ব্রিটেন: আবেদনকারীর দেশে তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শের মতো কয়েকটি ক্ষেত্রকেই বাছা হয়েছে। এগুলি ব্যতিত অন্য কারণ থাকলে আবদন খারিজ হতে পারে।
আমেরিকা: জাতি, বর্ণ, ধর্ম, নাগরিকত্ব,রাজনৈতিক মতাদর্শের মতো কয়েকটি বিষয়ে নির্যাতিত বা নির্যাতনের আশঙ্কা থাকলে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করা যায়। তবে আবেদনকারীকে অবশ্যই আমেরিকায় পৌঁছে তা করতে হবে।
ফিনল্যান্ড: ফিনল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে গেলে আবেদনকারী নির্যাতিত বা নির্যাতনের আশঙ্কা থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া কয়েকটি শর্তও মানতে হয়।
নরওয়ে: প্রথম বিশ্বের বাকি দেশগুলির মতোই নরওয়েতেও কম বেশি একই বিধি মেনে চলা হয়। তবে অপরাধের রেকর্ড থাকলে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার এই দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় মেলা বেশ কঠিন।
প্রসঙ্গত, ক্রমশ বাড়তে থাকা জনরোষে বাংলাদেশের পরিস্থিতি চরমে পৌঁছলে সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে বোন রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সন্ধ্যা নাগাদ তিনি ভারতে পৌঁছন। দিল্লি লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের গাজ়িয়াবাদের হিন্দন বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নামে তাঁর বিমান। তার পর সেই রাতেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল দেখা করেন হাসিনার সঙ্গে। সূত্রের খবর, বাংলাদেশের সদ্যপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি। আশ্রয় চাননি ব্রিটেন কিংবা আমেরিকার কাছেও। এর পরেই হাসিনার পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, খুব অল্প সময়ের নোটিসে ভারতে আসার আর্জি জানিয়েছিলেন হাসিনা। ভারত সেই অনুমতি দেওয়ার পরই বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে এসেছেন তিনি। তবে হাসিনা কিংবা বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, তা খোলসা করেননি জয়শঙ্কর।