Syria War

সিরিয়া কাঁপানো ১২ দিন! কী ভাবে ২৪ বছরের বাশার-‘সাম্রাজ্য’ গুঁড়িয়ে দামাস্কাস দখল সম্ভব হল

২৪ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে ছিলেন বাশার আল আসাদ। বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের অভ্যুত্থানে তাঁর সরকার পড়ে গিয়েছে। দেশ ছাড়তে হয়েছে বাশারকে। কী এমন ঘটল এই ১২ দিনে?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০০
How Syria Government led by Bashar al-Assad collapses in just 12 days

বাশার আল আসাদের সরকার পড়ে গিয়েছে মাত্র ১২ দিনের বিদ্রোহী অভ্যুত্থানে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের ‘সাম্রাজ্য’-এর পতন হয়েছে। সিরিয়া ছেড়ে বিদ্রোহের মুখে পালিয়ে গিয়েছেন তিনি। রাজধানী দামাস্কাস দখল করে নিয়েছেন বিদ্রোহীরা। বাশারকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। দেশ ছেড়ে সপরিবার সেখানেই আছেন তিনি।

Advertisement

২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেছিলেন বাশার। তাঁর আগে তাঁর বাবা দীর্ঘ দিন ওই কুর্সিতে ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় বাশার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। শুরু হয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। প্রথম থেকেই এই যুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল আমেরিকা। অন্য দিকে, সিরিয়া সরকার রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তা পেয়েছিল। গত ১৩ বছর ধরে কড়া হাতে যাবতীয় বিদ্রোহ দমন করেছে বাশারের প্রশাসন। কিন্তু তাঁর পতনের সূচনা হয় গত ২৭ নভেম্বর। মাত্র ১২ দিনে তাঁর সরকার পড়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি তাঁকে দেশ ছাড়তেও বাধ্য করেছে। কী এমন হল এই ১২ দিনে? বিদ্রোহীরা ১৩ বছরের চেষ্টায় যা করতে পারেননি, কী ভাবে মাত্র ১২ দিনে তা করে দেখালেন?

সিরিয়ার শহরে বিদ্রোহীদের আগ্রাসন।

সিরিয়ার শহরে বিদ্রোহীদের আগ্রাসন। ছবি: সংগৃহীত।

বস্তুত, পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ চলছে। সিরিয়া সরকারের অন্যতম দুই সমর্থকই যুদ্ধে ব্যস্ত। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। ইরান ব্যস্ত পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে। সিরিয়ার সরকার ফেলার জন্য এই সময়টিকেই উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহী দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনীর আগ্রাসনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সিরিয়ার সরকার। মিত্র দেশগুলির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাননি বাশার। ফলে বিদ্রোহীদের আগ্রাসনের মুখে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেননি তিনি।

গত ১২ দিনে সিরিয়ার মূল ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হল।

২৭ নভেম্বর: উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলিতে হামলা চালায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা দাবি করে, উত্তর-পশ্চিম আলেপ্পো প্রদেশের ১৫টির বেশি গ্রাম তারা সরকারের দখলমুক্ত করে ফেলেছে। এই অভিযানের নেপথ্যে ছিল মূলত এইচটিএস। সরকারের তরফে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। বিদ্রোহীদের উপর আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে সিরিয়া সরকার এবং তার সহযোগীরা।

২৮ নভেম্বর: সরকারের প্রতিরোধে লাভ হয়নি। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আরও এগোতে শুরু করেন বিদ্রোহীরা। সীমান্তলাগোয়া ইদলিব প্রদেশে তাঁরা ঢুকে পড়েন। খবর পাওয়া যায়, সরকারের বাহিনী পিছু হটছে।

দামাস্কাস দখলের পর মসজিদে সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা আবু মহম্মদ আল গোলানি।

দামাস্কাস দখলের পর মসজিদে সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা আবু মহম্মদ আল গোলানি। ছবি: রয়টার্স।

২৯ নভেম্বর: সিরিয়ার বৃহত্তম শহর আলেপ্পোতে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহী বাহিনী। ২০১৬ সালে এই শহর থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তায় সিরিয়া সরকার আলেপ্পোয় সামরিক অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২৯ তারিখে আবার সেই শহরে প্রবেশ করেন তাঁরা। কিন্তু এ বার তেমন কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।

৩০ নভেম্বর: বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেন, আলেপ্পো তাঁদের দখলে। শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তাঁরা দখল করে নেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে পুঁতে দেন নিজেদের পতাকা। মধ্য সিরিয়ার হামা প্রদেশের অন্তত চারটি শহর ওই দিন সন্ধ্যার মধ্যেই বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। প্রাদেশিক রাজধানীতেও ঢুকে পড়েন তাঁরা।

১ ডিসেম্বর: পাল্টা আঘাত হানে সিরিয়া সরকার। দেশের সেনাবাহিনী ইদলিব এবং আলেপ্পোতে আকাশপথে হামলা চালায়। সড়কপথেও সিরিয়ার সেনা বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হয়। ওই দিনই দামাস্কাসে যান ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। প্রেসিডেন্ট বাশারকে তিনি আশ্বাস দেন, তেহরান তাঁর পাশে আছে।

২ ডিসেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর: এক দিকে বাধা পেয়ে অন্য দিকে অগ্রসর হয় বিদ্রোহী বাহিনী। দক্ষিণে এগিয়ে হামা শহরের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকে পড়ে তারা। হামা সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। রাজধানী দামাস্কাস থেকে হামার দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। এই পর্যায়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য বাশারকে অনুরোধ করে তুরস্ক।

বাশারের পলায়নের পর দামাস্কাসের রাস্তায় পড়ে তাঁর বাবা তথা প্রাক্তন সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট হাফিজ় আসাদের ভাঙা মূর্তি।

বাশারের পলায়নের পর দামাস্কাসের রাস্তায় পড়ে তাঁর বাবা তথা প্রাক্তন সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট হাফিজ় আসাদের ভাঙা মূর্তি। ছবি: এপি, পিটিআই।

৫ ডিসেম্বর: হামা শহরে ঢুকে পড়েন বিদ্রোহীরা। এই শহরের আসি স্কোয়্যার এলাকা ২০১১ সালের বিদ্রোহের ‘আঁতুড়ঘর’ ছিল। ২০২৪-এ এসে আবার সেখানে আধিপত্য কায়েম করে বিদ্রোহী বাহিনী। আনন্দে শূন্যে গুলি ছুড়তে দেখা যায় তাদের।

৬ ডিসেম্বর: আরও এগিয়ে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহীরা। এই শহরকে রাজধানীর প্রবেশপথ বলা চলে। সেই সঙ্গে এই হোমসেই রয়েছে সিরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত দু’টি তৈল শোধনাগার। ফলে শহরটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। হোমস থেকে সরকারের বাহিনী পিছু হটেছে— এই তথ্য অস্বীকার করে বাশারের প্রশাসন। অন্য দিকে, সিরিয়া নিয়ে কাতারের রাজধানী দোহায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়। তাতে যোগ দেন সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক, ইরান এবং রাশিয়ার প্রতিনিধি।

৭ ডিসেম্বর: হোমস থেকে সরকারের সমস্ত বাহিনী সরে যায়। শহরটি পুরোপুরি বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। তাঁরা ঘোষণা করেন, দামাস্কাস তাঁরা ঘিরে ফেলেছেন। অভিযানের শেষ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন।

৮ ডিসেম্বর: সিরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাশারের সরকার পড়ে গিয়েছে। বন্দিদের মুক্ত করা হয়েছে। বিদ্রোহী নেতা গোলানি দামাস্কাসের মসজিদে যান এবং জয় ঘোষণা করেন। রাশিয়া এবং ইরানের সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাশার সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় চলে গিয়েছেন। তাঁর পরিবারও সেখানেই রয়েছে। রাশিয়া তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ গাজ়ি জালালি সুর নরম করেন। জানান, সিরিয়া সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মেলাতে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত।

Advertisement
আরও পড়ুন