তালিবান মুখপাত্র জবিউল্লা মুজাহিদ। ছবি: সংগৃহীত।
পঞ্চশীল। তবে পঞ্চাশের দশকের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জমানায় ভারত-চিন চুক্তির নয়। আফগানিস্তানের নয়া তালিবান শাসকদের স্বনির্ধারিত পাঁচ ‘সংযমের’। যদিও সেই প্রতিশ্রুতি পালনের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই।
রাজধানী কাবুল দখলের পর প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই ‘বার্তা’ দিয়েছিলেন তালিবানের প্রধান মুখপাত্র জবিউল্লা মুজাহিদ। স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘‘আফগানিস্তানের মাটিকে আর অন্য কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।’’ পাশাপাশি, শরিয়ত আইন মেনে মেয়েদের অধিকার দেওয়া, পূর্বতন সরকারের কর্মী ও আধিকারিকদের সাধারণ ভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের কথাও বলেন তিনি।
এর পর তালিবান মুখপাত্র সুহেল শাহিন, তালিবান সাংস্কৃতিক কমিশনের সদস্য এনামুল্লা সামাঙ্গনি, মিডিয়া টিমের সদস্য আব্দুল হক হেমন্দদের মুখে শোনা গিয়েছে এমন ‘সংযমের’ নানা অঙ্গীকার। চুম্বকে যা এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচটি বিষয়ে। তবে ইতিমধ্যেই রাজধানী কাবুল-সহ বিভিন্ন প্রদেশে তালিবান বাহিনীর আচরণ দেহে প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মহিলাদের অধিকারের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জবিউল্লার মন্তব্য ছিল, ‘‘আজ থেকে ২০ বছর আগে পৃথিবীটা যেমন ছিল, আজ আর তেমন নেই। অনেক কিছু বদল হয়েছে।’’ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শরিয়তি আইন মেনে প্রশাসনে ও সরকারি কাজে মহিলাদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কাজ হারিয়েছেন বেশ কিছু মহিলা। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া তাঁদের বাড়ির বাইরে বেরনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি, মিলেছে মহিলাদের চাবুক মারার ফুটেজও।
আশরফ গনি সরকারের আধিকারিকদের এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের কথাও বলেছিলেন জবিউল্লা। একই কথা শোনা গিয়েছিল শাহিনের মুখেও। তবে এ ক্ষেত্রে, আফগান সেনার কর্মী বা গোয়েন্দা আধিকারিকরাও থাকবেন কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানাননি তাঁরা। বুধবার রাতে আফগান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দফতরের প্রাক্তন আধিকারিককে তালিবান গুলি করে মেরেছে। অর্থাৎ ক্ষমা প্রদর্শন যে পাইকারি হারে হবে না, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।
বিদেশি দূতাবাস এবং সংস্থাগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও শোনা গিয়েছে তালিবান মুখপাত্রের মুখে। সেই সঙ্গে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন তালিবান আর অন্য দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। বস্তুত, এ প্রসঙ্গে সরাসরি কাশ্মীর সমস্যা এবং ভারত-পাক সঙ্ঘাতের কথাও বলেছেন তিনি। জবিউল্লার স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘কাশ্মীর দ্বিপাক্ষিক এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাশ্মীরের প্রতি আমাদের কোনও নজর নেই। আমরা এখন কারও সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি করতে চাই না।’’
জবিউল্লার এই মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক মহলের একাংশ। কারণ, মোল্লা মহম্মদ ওমরের জমানা থেকে একাধিক বার কাশ্মীরে সক্রিয় পাক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে তালিবান। ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বিমান ছিনতাইকারী জঙ্গিদের কন্দহরে আশ্রয় দিয়েছিল তারা। জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলেরও সমালোচনা করেছিল তালিবান। এই পরিস্থিতিতে তালিবান মুখপাত্র কার্যত কাশ্মীর নিয়ে ভারতের ছ’দশকের পুরনো অবস্থানকেই মেনে নেওয়ার বার্তা দেন। তবে ইতিমধ্যেই কয়েকটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে আফগানিস্তানের মাটিতে জৈশ-ই-মহম্মদ, লস্কর-ই-জঙ্গভির মতো সংগঠনের ‘সক্রিয়তা’র কথা জানানো হয়েছে।
তা ছাড়া, বিদেশি দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির উপরে তালিবানের হামলার ইতিহাসও পুরনো। ১৯৯৬ সালে কাবুল দখলের পরে তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরে হামলা চালিয়ে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লাকে খুন করেছিল। বছর দু’য়েক পর মাজার-ই-শরিফ দখলের পরে বিদেশি কনস্যুলেটে ঢুকে খুন করে কয়েকজন কূটনীতিককে।
তালিবান মুখপাত্র আফগানিস্তানে মাদকের কারবার বন্ধেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও নানা রিপোর্ট বলছে, আফিম চাষ এবং মাদক উৎপাদন তালিবান অর্থনীতির অন্যতম ‘স্তম্ভ’। বছর তিনেক আগের একটি রিপোর্ট বলছে, ড্রাগের ব্যবসা এবং চোরাচালান থেকে তালিবানের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নীলকর সাহেবদের ধাঁচেই অধিকৃত এলাকায় কৃষকদের জোর করে আফিম চাষ করায় তারা। এ ছাড়া তালিবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ড্রাগ তৈরির কারখানা রয়েছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চক্রের। আশ্বাস দিলেও বিপুল আয়ের এই উৎসে আঘাত করার সদিচ্ছা তালিবানের রয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান আন্তর্জাতিক মহল।