পৃথিবী জুড়েই কদর রয়েছে এই মূল্যবান ধাতুটির। যুগের পর যুগ ধরে সোনার গয়না পরার চল বিশ্বে। বিশ্ববাজারে সোনার ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে তা জমানোর প্রবণতা বেশ কয়েক দশক ধরে বেড়েই চলেছে। নিরাপদ সম্পদ হিসাবে হলুদ ধাতুতে বিনিয়োগেই আস্থা রাখছে আমজনতা থেকে রাষ্ট্রশক্তিও।
বাণিজ্যে মন্দা, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ-সংঘাত, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের মতো রাষ্ট্র-সঙ্কটে সোনাকে নিরাপদ বিনিয়োগ বলে ধরা হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সোনা। কাজ করে দেশীয় মুদ্রার ওঠানামা এবং আর্থিক সঙ্কটের বিরুদ্ধে সুরক্ষাকবচ হিসাবে।
দেশের মুদ্রার দর নিয়ন্ত্রণেও সোনার ভূমিকা রয়েছে। তাই বিশ্ববাজারে বাড়ছে সোনার চাহিদা ও দাম। অর্থনীতিতে যখন টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন সেই অস্থির পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে জমিয়ে রাখা সোনার হাতেই।
স্থানীয় মুদ্রার দর পড়লেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালাতে যাতে সমস্যায় পড়তে না-হয়, তাই নিজেদের রাজকোষে টন টন সোনা জমাচ্ছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই। ব্যতিক্রম নয় ভারতও। ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়লেও ভারত চাইছে সোনা মজুতকে সামনে রেখে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ সুগম রাখতে।
সোনা জমানোর নিরিখে ভারতের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। কোন দেশের হাতে কী পরিমাণ সোনা জমা করে রাখা আছে, তার একটি তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল। সেই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ভারতও। তালিকার নীচের দিকে রয়েছে ভারতের স্থান।
সোনা মজুতের দিক থেকে সবচেয়ে উপরের স্থান দখল করে রয়েছে, বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ আমেরিকা। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতে থাকা মজুত সোনার পরিমাণ ৮১৩৩.২৬ টন। যা তার মোট বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের প্রায় ৭৪ শতাংশের সমান।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত শতকের শেষ দিক থেকে আমেরিকা সোনা জমানোর দিকে নজর দিতে থাকে।
১৯৩৪ সালের সে দেশের ‘গোল্ড রিজার্ভ অ্যাক্ট’ জারি করে সোনার ব্যক্তিগত মালিকানা সীমিত করা হয় ও রফতানি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আইনে ব্যক্তিগত সোনাও রাজকোষে স্থানান্তরিত করা হয়। তার জেরে উল্লেখযোগ্য ভাবে সে দেশের সোনার ভাঁড়ার বৃদ্ধি পায়।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় যে পরিমাণ সোনা মজুত করা রয়েছে, তার পরিমাণ ফ্রান্স, ইটালি এবং জার্মানির সম্মিলিত সম্পদের প্রায় সমান। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়, আমেরিকার এই সোনার ভান্ডার ফোর্ট নক্স, ডেনভারের টাঁকশাল এবং ওয়েস্ট পয়েন্ট বুলিয়নে রয়েছে।
আমেরিকার পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানি। তাদের হাতে ৩,৩৫৯.১ মেট্রিক টন সোনা সঞ্চিত রয়েছে। সম্প্রতি জার্মানি এই সোনা সঞ্চয় বৃদ্ধি করেছে। ইউরোপের এই দেশটির বৈদেশিক তহবিলের প্রায় ৭৩ শতাংশ দখল করে আছে হলুদ ধাতু।
জার্মানির বেশির ভাগ সোনা নিউ ইয়র্ক, লন্ডন এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে মজুত আছে। ১৯২০ সালে মুদ্রাস্ফীতির থেকে শিক্ষা নিয়ে জার্মানি আর্থিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য সোনা জমানোয় মনোনিবেশ করে। বর্তমানে জার্মানি বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
ইউরোপের আরও দু’টি দেশ নিজেদের সোনার তহবিলকে শক্তিশালী করে তুলেছে। আমেরিকা, জার্মানির পরেই তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইটালি। তাদের কাছে সঞ্চিত সোনার পরিমাণ ২,৪৫১.৮ মেট্রিক টন। ইটালির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, ‘ব্যাঙ্কা ডি’ইতালিয়া’ এই সোনার ভাঁড়ার পরিচালনা করে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়, রাজধানী রোমে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কে সোনাগুলি সুরক্ষিত ও নিরাপদে জমা রেখেছে দক্ষিণ ইউরোপের এই দেশ।
অর্থনীতির দিক থেকে বর্তমানে বিশ্বের সপ্তম তালিকায় ফ্রান্স। সোনা জমানোর নিরিখে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চতুর্থ স্থানে থাকা ফ্রান্সের ‘গোল্ড রিজার্ভ’ প্রায় ২ হাজার ৪৩৬ টন। ‘ব্যাঙ্ক ডি ফ্রান্সে’র প্যারিসের সদর দফতরে জমা রয়েছে এই বিপুল পরিমাণ সোনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রান্সের সোনার তহবিল বাড়তে থাকে।
‘গোল্ড রিজার্ভে’র দিক থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই এশিয়ার মহাশক্তিধর চিন। এ দেশে গোল্ড রিজার্ভের পরিমাণ রয়েছে ২২৬৪ টন। তালিকার পঞ্চম স্থান দখল করে আছে ড্রাগনের দেশ।
সুইৎজ়ারল্যান্ডের হাতে রয়েছে ১০৩৯ টন সোনা। সোনা মজুতের নিরিখে এই তালিকায় সুইৎজ়ারল্যান্ডের রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। চিনের থেকে সুইৎজ়ারল্যান্ডের মজুত সোনার পরিমাণ অর্ধেকেরও কম।
এশিয়ার আর এক দেশ জাপানকে পিছনে ফেলে তালিকার সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে ভারত। ডলার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল কমিয়ে সোনা জমানোর পথে হাঁটছে নয়াদিল্লি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলেছে, চলতি বছরে রেকর্ড সোনা মজুত করেছে ভারত।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত ভারতের হাতে মোট ৮৫৮.৩ টন সোনা মজুত রয়েছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানিয়েছে, চলতি বছরের অক্টোবরে সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি যে পরিমাণ সোনা কিনেছিল তার ৪৮ শতাংশই ছিল ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে রিপোর্টের ভিত্তিতে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে আরবিআই ৭৭ টন সোনা কিনেছে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।
ভারতের পর রয়েছে জাপান। জাপানের গোল্ড রিজার্ভ প্রায় ৮৪৫ টনের। তালিকার নয় নম্বরে থাকা নেদারল্যান্ডসের কাছে সোনা রয়েছে প্রায় ৬১২ টন। দশ নম্বরে রয়েছে তুরস্ক। কামাল আতাতুর্কের দেশের হাতে মজুত রয়েছে ৫৯৫ টন সোনা।
সব ছবি :সংগৃহীত।