Indo-Bangladesh Relations

স্বাস্থ্যোদ্ধারে পশ্চিমে নয়, পুবে যেতে চাইছে ঢাকা, চিন-করুণায় কুনমিং হতে চলেছে কলকাতার বিকল্প?

কলকাতার বদলে এ বার কুনমিংয়ের নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজার? চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নিজের দেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন তৌহিদ।

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৩২
China designates Kunming hospitals for treatment of Bangladeshi patients, Is the Yunnan capital going to snatch business from Kolkata

(বাঁ দিকে) মুহাম্মদ ইউনূস। নরেন্দ্র মোদী (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

কলকাতার বদলে কুনমিং! বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যোদ্ধারে ভারতীয় ভিসার বদলে কি এ বার চিনা ভিসার চাহিদা বাড়তে চলেছে? সম্প্রতি চিনা বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের ইউনূস সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। ঢাকার একটি সূত্রের দাবি, বাংলাদেশি নাগরিকদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতার ‘বিকল্প’ ব্যবস্থা করে দিতে চিনকে অনুরোধ করেছেন তিনি। সেই সূত্রে দাবি, অনুরোধ পেয়ে চিনের সরকার কুনমিং শহরের ৩-৪টি হাসপাতালকে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

Advertisement

কুনমিং কি তা হলে হয়ে উঠতে পারে কলকাতার ‘বিকল্প’? ভাবনায় কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারণ, বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের রোগীদের যাতায়াতে কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল (মূলত ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস লাগোয়া) তাদের বাণিজ্য বাড়িয়েছে। শুধু হাসপাতালই নয়, সে সব হাসপাতালের লাগোয়া এলাকায় শুরু হয়েছে তুলনায় সস্তার ‘লজ’, ট্র্যাভেল এজেন্সি, খাবারের দোকান ইত্যাদি, পরিভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে ‘স্বাস্থ্য পর্যটন’। চিনের করুণায় কি মার খেতে পারে কলকাতার স্বাস্থ্য পর্যটনের অর্থনীতি?

গত বছর ৫ অগস্টের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ আবহাওয়ার সম্মুখীন। ভারতীয় ভিসা এখন বাংলাদেশিদের জন্য দুর্লভ। গুরুতর অসুস্থতা বা আপৎকালীন পরিস্থিতির প্রমাণ দিতে পারলে ‘মেডিক্যাল ভিসা’ মিলছে। কিন্তু ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’ মিলছে না। স্বভাবতই কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কলকাতার বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর হিসাব বলছে, বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছে!

প্রথমে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলি ভেবেছিল, ওই ধাক্কা ‘সাময়িক’। আশা ছিল, দ্রুত বাংলাদেশে স্বাভাবিকতা ফিরবে। আবার ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া শুরু হবে। ফলে অক্ষুণ্ণ থাকবে রোগীর স্রোত। কিন্তু কাহিনিতে নতুন বাঁক এনেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের চিন সফর। চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নিজের দেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন তৌহিদ। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের দাবি, তৌহিদের অনুরোধে চিন সাড়াও দিয়েছে। বাংলাদেশের সামনে কলকাতার ‘বিকল্প স্বাস্থ্যোদ্ধার গন্তব্য’ হিসেবে কুনমিং শহরকে পেশ করেছে চিন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এমনই লেখা হয়েছে।

তা হলে কি কলকাতার বদলে এ বার কুনমিংয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজার? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর অবশ্য তা মনে হচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য কোনও শহরই কলকাতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। কলকাতা তাঁদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক শহর বলেই বাংলাদেশিরা এখানে আসেন।’’ অভিজিতের ব্যাখ্যা, ‘‘ভাষা, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি— সব দিক দিয়ে কলকাতা বাংলাদেশিদের কাছে সুবিধাজনক। খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ইত্যাদি প্রায় হুবহু মেলে বলেই চিকিৎসার জন্য অনেক দিন থাকতে হলেও বাংলাদেশিদের কোনও অসুবিধা হয় না। বাংলাভাষী চিকিৎসকদের নিজের সমস্যা বোঝাতেও অসুবিধা হয় না। কুনমিংয়ে চিকিৎসা করাতে গেলে সে সব হবে কি?’’

আর এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগির মেনে নিচ্ছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে কলকাতায় স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা আবার আগের জায়গায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে।’’ কিন্তু গৌতমও মনে করছেন না যে, চিনের কুনমিং শহর বাংলাদেশিদের কাছে কলকাতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশি রোগীরা চিনের কুনমিং সিটিতে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়। কলকাতায় যতটা সহজে সব হয়, কুনমিংয়ে সেই সুবিধা মিলবে না। ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের বাংলাদেশি বাজার যে আবার ফিরে পাবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’’

কলকাতার চিকিৎসকেরা কেন এমন মনে করছেন, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বিদেশ থেকে রোগী আনার ব্যবস্থাপকেরা। যাঁদের পোশাকি নাম ‘কো-অর্ডিনেটর’ বা ‘কমপ্লায়েন্স অফিসার’। তাঁদের মূল কাজ দালালদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে নিজের নিজের হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর স্রোত সুনিশ্চিত করা। স্বভাবতই কেউ তাঁদের নামপ্রকাশে ইচ্ছুক নন। কিন্তু প্রত্যেকেই জানাচ্ছেন, ‘থ্রি-লেয়ার কমিউনিকেশন’-এর কথা। কাজ হয় ত্রিস্তরে। প্রথম স্তরে রোগী বা তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় ঢাকায়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানেই স্থির হয়ে যায় হাসপাতাল বা চিকিৎসকের নাম। না হলে বেনাপোল পৌঁছনোর পর দেখা মেলে দালালদের সঙ্গে। সেটি দ্বিতীয় স্তর। সেখানেও ব্যবস্থা না হলে তৃতীয় স্তর কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিট-কিড স্ট্রিট এলাকায়। বাংলাদেশি রোগীরা বা তাঁদের পরিবার ওই এলাকার বিভিন্ন হোটেলে ওঠেন। বিভিন্ন হাসপাতালের এজেন্টরা সেখানেই ওত পেতে থাকেন দিনভর। কলকাতার বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি হাসপাতাল এবং বেশ কয়েক জন নামী চিকিৎসক ঢাকায় নিজেদের ‘আউটডোর’ খুলে রেখেছেন বলেও এই ‘কো-অর্ডিনেটর’রা জানাচ্ছেন। সেই সূত্রেই তাঁদের অভিমত, ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চিকিৎসা আদানপ্রদানের এই ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ বন্দোবস্ত ঢাকা-কুনমিংয়ের মধ্যে তৈরি হওয়া সহজ নয়।

বেঙ্গালুরুভিত্তিক এক হাসপাতাল চেনের ‘কমপ্লায়েন্স অফিসার’ বলছেন, ‘‘ভারতের সব কিছু বর্জন করতে হবে বলে এখন বাংলাদেশে স্লোগান তোলা হচ্ছে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই স্বাস্থ্য পর্যটনে কলকাতার বিকল্প গন্তব্য দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অনেক স্মার্ট। তাঁরা জানেন কোথায় তাঁদের সুবিধা আর কোথায় অসুবিধা।’’

বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে কুনমিংয়ের চিকিৎসা করানোয় ‘অসুবিধা’ আরও আছে। ঢাকা থেকে কলকাতা সড়কপথ বা রেলপথে আসা যায় কয়েক ঘণ্টায়। কুনমিংয়ে সে ভাবে পৌঁছনো অসম্ভব। একমাত্র মাধ্যম উড়ান। তা-ও কোনও সরাসরি উড়ান নেই। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে কুনমিং পৌঁছনোর কয়েকটি উড়ান রয়েছে। সে উড়ানে টিকিট না মিললে প্রথমে ঢাকা থেকে চিনের পিকিং বিমানবন্দর বা গুয়াংঝো বিমানবন্দরে যেতে হবে। সেখানে ৭ ঘণ্টা বা ১০ ঘণ্টার বিরতির পরে আবার কুনমিংয়ের উড়ান ধরতে হবে। অসুস্থ রোগীকে নিয়ে সেই যাত্রাপথ, বলা বাহুল্য, ‘সুবিধাজনক’ নয়। ফলে বাংলাদেশের তদারকি সরকার নতুন স্বাস্থ্য পর্যটনস্থল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে ভয়ে এখনও কম্পিত নয় কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের হৃদয়।

Advertisement
আরও পড়ুন