Teacher Recruitment Scam

শিক্ষক নিয়োগে গঙ্গাপারের মতো ‘অনিয়ম’ পদ্মাপারে, শূন্য থেকে ৫০ কোটির মালিক গাড়িচালক জিয়াউর

ঢাকা শহরের দক্ষিণ কেরানিগঞ্জে জিয়াউরের সাত তলা বাড়ি। আগামসি লেনে দামি ফ্ল্যাট। আশুলিয়া এলাকায় একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির মালিকও তিনি। এ সবের মোট দাম কয়েক কোটি টাকা।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২২ ১৮:১৫
জিয়াউর বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন (এনটিআরসিএ)-এর চেয়ারম্যানের গাড়িচালক।

জিয়াউর বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন (এনটিআরসিএ)-এর চেয়ারম্যানের গাড়িচালক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পেশায় গাড়িচালক। সরকারি সেই চাকরিতে বেতন পেতেন মাসিক ১২ হাজার টাকা। সেই মহম্মদ জিয়াউর রহমান এই মুহূর্তে ৫০ কোটি টাকার মালিক!

শুধু তা-ই নয়, ঢাকা শহরে একের পর এক দামি বাড়ি, আত্মীয়-পরিজনদের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ও ব্যাঙ্ক ব্যালান্স তাঁর। বাংলাদেশের এই অভিযোগ মুহূর্তে মনে করিয়ে দিয়েছে সীমান্তের এ পারের রাজ্যটির কথা। কাকতালীয়। কিন্তু গঙ্গাপারের কলকাতার মতো পদ্মাপারের বাংলাদেশের এই আখ্যানও নিয়োগ দুর্নীতিরই অঙ্গ।

Advertisement

জিয়াউর বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন (এনটিআরসিএ)-এর চেয়ারম্যানের গাড়িচালক। যদিও নিজের এলাকায় তিনি ‘শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িচালক’ বলেই পরিচিত। এনটিআরসিএ বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রকের আওতায় থাকা একটি স্বশাসিত সংস্থা। দেশের প্রায় ৩৩ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করাই ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ। ২০০৫ সালে তৈরি ওই প্রতিষ্ঠানে প্রথম দিন থেকেই গাড়িচালকের কাজ করেন জিয়াউর। তিনি প্রথম থেকেই চেয়ারম্যানের গাড়ি চালাতেন।

দেশব্যাপী স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও কম্পিউটারচালিত পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা নেওয়া এবং ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের শংসাপত্রও দেয় ওই প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ, সেই প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির বাসা বেঁধেছিলেন জিয়াউর। বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যখন শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, তখন এনটিআরসিএ পাশ শংসাপত্রধারীরা শূন্যপদের ভিত্তিতে অনলাইনে আবেদনপত্র পাঠান। নিয়ম মতো তার পরেই যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানেই জিয়াউরদের হাত ধরে ঘুঘুর বাসা গড়ে উঠেছিল বলে অভিযোগ।

জিয়াউরের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি ২ লাখ টাকার বিনিময়ে এনটিআরসিএ শংসাপত্রের ব্যবস্থা করে দিতেন। শুধু তা-ই নয়, ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুপারিশ করে দিতেন। পাইয়ে দিতেন চাকরিও। এ কাজে তাঁর অন্যতম সহযোগী হিসাবে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে এনটিআরসিএ-র ‘সিস্টেম অ্যানালিস্ট’ ওয়াসিউদ্দিন রাসেল নামে এক জনের বিরুদ্ধে। তিনি যদিও এই মুহূর্তে সরকারি চাকরি ছেড়ে সপরিবার কানাডায় থাকেন। অভিযোগ, জিয়াউর টাকা তুলতেন। আর রাসেল সেই টাকার ভিত্তিতে প্রার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া থেকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার সুপারিশপত্র সবটাই বানিয়ে দিতেন।

ঘটনাচক্রে, এ পার বাংলায় যখন শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে যুক্ত শাসকদলের বিধায়ক, আতশকাচের তলায় রয়েছেন শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত একের পর এক ব্যক্তি, তখন ও পার বাংলার বাসিন্দা জিয়াউরের ‘টাকার বিনিময়ে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া’র বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এ এক আশ্চর্য সমাপতনই বটে!

২০০৫ সালে জিয়াউর যখন গাড়িচালকের চাকরিতে যোগ দেন, তখন তাঁর মূল বেতন ছিল ৩৩০০ টাকা। সব মিলিয়ে হাতে পেতেন ১২ হাজার। এখন সেই বেতন বেড়ে হয়েছে ৩৬ হাজার টাকা। গত ১৭ বছরে এনটিআরসিএ-তে ১৮ জন চেয়ারম্যান এসেছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই গাড়ি চালাতেন জিয়াউর। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান মহম্মদ এনামুল কাদের খানের গাড়ি তিনি চালান না। কাদের বাংলাদেশের সংবাদপত্র ‘দেশ রূপান্তর’-এর প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, তিনি সাড়ে চার মাস ওই পদে এসেছেন। তাঁর সময়ে কোনও পরীক্ষা হয়নি। জিয়াউর নামে তিনি কোনও গাড়িচালককে চেনেন না বলেও দাবি করেছেন কাদের।

বাংলাদেশের ওই সংবাদপত্রের বক্তব্য, জিয়াউরের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে। ঢাকার দক্ষিণ কেরানিগঞ্জে রয়েছে সাত তলা বাড়ি। আগামসি লেনে রয়েছে দামি ফ্ল্যাট। আশুলিয়া এলাকায় একটি নির্মীয়মান বাড়ির মালিকও তিনি। এ সবের দাম কয়েক কোটি টাকা। যশোহর শহরেও জিয়াউল তৈরি করছেন একটি ছ’তলা বাড়ি। তার দাম প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া যশোহরের রূপদিয়া এলাকায় জিয়াউরের স্ত্রী, স্ত্রীর বোন ও তাঁর ভাইয়ের নামে কয়েক বিঘা সম্পত্তি রয়েছে। এ সবের মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে জিয়াউরের আরও সম্পত্তি রয়েছে বলেও অভিযোগ। রয়েছে চারটি মাইক্রোবাস। সেগুলি সবই ভাড়ায় খাটানো হয়। জিয়াউরের সঙ্গে ওই সংবাদপত্রের তরফে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ফোন ধরলেও তিনি ওই বিষয়ে কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দেন বলে জানিয়েছে ওই সংবাদপত্র।

আরও পড়ুন
Advertisement