বর্ধমান স্টেশনে ভেঙে পড়ল জলের ট্যাঙ্ক। — নিজস্ব চিত্র।
স্টেশনের বিভিন্ন পরিকাঠামোরই পরীক্ষানিরীক্ষা হয় নিয়মিত। কোথায় সব কিছু ঠিক আছে, কোথায় সংস্কার দরকার, কোথায় মেরামতি প্রয়োজন, তা ভাল করে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট পাঠানো হয় রেলের উচ্চ স্তরে। বর্ধমান স্টেশনে বুধবার জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়ে যে ভাবে তিন জনের বেঘোরে প্রাণ গেল, তাতে প্রশ্ন উঠছে, লোহার ওই ট্যাঙ্কটির ‘জীর্ণ’ দশার কথা কি কখনও ওই সমস্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি? রেলের অন্দরেরই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, আদৌ শতাধিক বছরের পুরনো ট্যাঙ্কটির পরীক্ষা হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে, তা হলে কী রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারেরা? বছর তিনেক আগে স্টেশনের ঐতিহ্যবাহী ভবনের ভেঙে পড়ার মতো এই ঘটনাতেও রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির তত্ত্ব বার বার ঘুরেফিরে উঠে আসছে।
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র যদিও জানিয়েছেন, কী কারণে ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়ল, তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে রাখা হয়েছে রেলের প্রবীণ তিন আধিকারিককে। তিন দিনের মধ্যে তাঁদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা।
বেলা তখন সাড়ে ১২টা। ব্যস্ত সময়। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে তখন আস্তে আস্তে ভিড় বা়ড়ছে। এমন সময়ে দুই ও তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝে ইংরেজ আমলের ওই জলের ট্যাঙ্কটির এক দিকের দেওয়াল ভেঙে হুড়মুড় করে জল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ট্যাঙ্কের ঠিক নীচেই শেড। ওই শেডের তলা তখন যাত্রীদের ভিড়ে গিজগিজ করছে। আচমকাই জলের তোড়ে ট্যাঙ্কের খানিকটা দেওয়াল ভেঙে পড়ে ওই শেডের উপর। টিনের শেড, লোহার কাঠামোর উপর বসানো। জল আর লোহার ভার সহ্য করতে না পেরে মুহূর্তের মধ্যেই শেডটি ভেঙে পড়ে ওই বিপত্তি ঘটে। এই ঘটনায় তিন জনের প্রাণ গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা— সোনারাম টুডু (৩৫) এবং ক্রান্তি বাহাদুর (১৬)। অন্য জন, মফিজা খাতুন (৩৫)। বর্ধমান শহরের লাকুড্ডির বাসিন্দা ছিলেন তিনি। জখম হয়েছেন অন্তত ৩৪ জন। তাঁদের বর্ধমান মে়ডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, ওই জলের ট্যাঙ্ক থেকে মাঝেমধ্যেই জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ত। এ ব্যাপারে রেলের কাছে অভিযোগও জানানো হয়। কিন্তু শুধু রং করেই ছেড়ে দেওয়া হত ট্যাঙ্কটি। ভেঙে পড়া ট্যাঙ্কটিকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, কিছু দিন আগেই সেটি রং করা হয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে কেন জল লিক করছে, তার পরীক্ষা করে মেরামত করা হয়নি। সঠিক ভাবে মেরামত হলে এই ঘটনা ঘটত না বলেই দাবি নিত্যযাত্রীদের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, দিন দিন সীমাহীন ‘অপদার্থতা’র দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে ভারতীয় রেল। তাঁদের মতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে কর্তব্যে গাফিলতি! বর্ধমান শহরের বাসিন্দা স্বপন মজুমদারের কথায়, ‘‘রেলপথে যাত্রাকে সুরক্ষিত যাত্রা মনে করে যাঁরা নিশ্চিন্তে ভারতীয় রেলে সফর করছেন, তাঁদের জন্য যত্রতত্র মৃত্যুর অপেক্ষা আজ। যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তাটুকুও কি নিশ্চিত করতে পারবে না রেল? অপদার্থতা ছাড়া আর কী-ই বি বলতে পারি বলুন।’’
রেলকর্মীদের একাংশও একান্ত আলোচনায় কর্তব্যে গাফিলতির কথাই স্বীকার করে নিচ্ছেন। রেল সূত্রেই খবর, জলের ট্যাঙ্কটি ১৮৯০ সালে অর্থাৎ, ১৩৩ বছর আগে তৈরি। জলধারণ ক্ষমতা ৫৩ হাজার গ্যালনেরও বেশি। সেটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের। তাদেরই সময়ে সময়ে এসে পরীক্ষা করার কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেলকর্মী জানান, বড় রেলস্টেশনগুলিতে তো এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা বাধ্যতামূলক। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই ধরনের পরীক্ষা হয়ে থাকে। কখনও জেনারেল ম্যানেজার (জিএম), কখনও বা বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম)-এর নেতৃত্বে তা হয়। সেই রিপোর্ট পৌঁছয় দিল্লিতে। তার ভিত্তিতে কাজ হয়। এ ক্ষেত্রে কি আদৌ জলের ট্যাঙ্কটির পরীক্ষা করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের কর্মীরা, সেই প্রশ্ন উঠছে। প্রাক্তন রেলকর্তা সমীর গোস্বামীও বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, অবহেলা ছিল। তদারকির অভাবও ছিল। ঠিক মতো পরীক্ষা করা হয়নি। প্রাথমিক ভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরেরই দায়।’’
রেলের ‘অকর্মণ্যতা’কে দায়ী করছেন আর এক প্রাক্তন রেলকর্তা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি বলেন, ‘‘এটা অকর্মণ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। দীর্ঘ দিন রেলে কাজ করেছি। বলতে বা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি।’’
গোটা ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে রেল। পাশাপাশিই পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক জানিয়েছেন, মৃতদের পরিবারকে পাঁচ লাখ ও জখমদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। এতেও যাত্রী-ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না। যাত্রীদের একাংশের বক্তব্য, বহিরঙ্গের জাঁকজমক আর প্রচারসর্বস্বতাই এখন রেলের সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলের উন্নয়ন নিয়ে রাশি রাশি কথা খরচ হচ্ছে, নানা পরিকল্পনাপত্র মেলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু ন্যূনতম যাত্রী-সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারছে না রেল! ঘটনার সময় বর্ধমান স্টেশনেই ছিলেন গুসকরার বাসিন্দা তরুণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘বার বার যা হয়েছে, এ বারও তা-ই হবে। খানিক নিন্দা হবে, খানিক সমালোচনার ঝড় বইবে, তার পর ধীরে ধীরে সব থিতিয়ে আসবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। ঠিক যেমনটা তিন বছর আগে ঘটেছিল।’’
২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি রাতে বর্ধমান স্টেশনের মূল প্রবেশপথে ঝুলবারান্দার একাংশ ভেঙে পড়ে এক যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। ধসে পড়ে তিন তলা ভবনের অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনের অংশও। রেল সূত্রে জানা গিয়েছিল, ১৯০৫ সালে তৈরি স্টেশন ভবনের মূল কাঠামো চুন-সুরকি ও ইট দিয়ে তৈরি। ছাদে লোহার কড়ি-বরগা। দুর্ঘটনার আগে সৌন্দর্যায়ন ও ভবন সংস্কারের জন্য সেখানে কাজ করছিল বরাতপ্রাপ্ত একটি ঠিকাদার সংস্থা। দুর্ঘটনায় ওই ভবনের আটটি স্তম্ভের মধ্যে দু’টি স্তম্ভ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সেই সময় রেলের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে ঠিকাদার সংস্থার ঘাড়েই যাবতীয় দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল অভিযুক্ত সংস্থার অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা নিয়ে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে ঠিকাদার সংস্থাকে বাছাই করেছিলেন রেলকর্তারা, সেই প্রশ্নের জুৎসই উত্তর মেলেনি।
বুধবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মেমারির বাসিন্দা কৌশিক মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই মারাত্মক অপরাধের দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে এবং দায়ীর বা দায়ীদের কঠোর দণ্ডই কাঙ্খিত। এ ভাবে চলতে থাকলে কিন্তু কোনও দিন জনরোষের মুখে পড়তে হবে রেলকে!’’