Chandrayaan-3 and Narendra Modi

চন্দ্রযানের সাফল্যের ‘বিক্রম’ সঙ্গী করেই লোকসভা ভোটে নামছেন মোদী, তবে ময়দান সহজে ছাড়ছেন না রাহুলরাও

চাঁদে পৌঁছেছে ভারতের চন্দ্রযান-৩। তার সাফল্য ইসরোর বিজ্ঞানীদের। কিন্তু বিজেপি মনে করে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব ছাড়া এটা সম্ভবই হত না। কংগ্রেস অবশ্য বলছে, ইসরো তো তৈরিই হয়েছিল তাদের জমানায়!

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৩ ২০:৩০
বৃহস্পতিবার ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা।

বৃহস্পতিবার ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা। ছবি: পিটিআই।

বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিট। চাঁদের মাটিতে সফল ‘ল্যান্ডিং’ চন্দ্রযানের। ৬টা ১৯ মিনিটে হোয়াট্‌সঅ্যাপ এল রাজ্য বিজেপির এক নেতার— ‘চন্দ্রযান পৌঁছেই বার্তা পাঠিয়েছে। লিখেছে, অব কি বার ফির মোদী সরকার’।

Advertisement

ঠিক তখনই চন্দ্রাভিযানে ভারতের সাফল্য নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বক্তৃতা করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া মোদী পটভূমিকায় জাতীয় পতাকা নিয়ে বলছেন, “আমার বিশ্বাস আমাদের আগামী প্রজন্ম চাঁদে পর্যটনের স্বপ্ন দেখবে। দূরের চাঁদমামা ‘ট্যুরে’র চাঁদমামা হবে।”

তার আগে চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের জন্য বিজ্ঞানীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এই সাফল্যে গোটা বিশ্ব উপকৃত হবে বলেও জানিয়েছেন। যা বলেননি, এর ফলে ‘উপকৃত’ হবেন তিনিও। তাঁর দল বিজেপি সেই বন্দোবস্ত সুচারু ভাবে করেছে। চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটি ছোঁয়ার কিছু ক্ষণ আগেই সরাসরি সম্প্রচারের স্ক্রিনে চলে আসেন মোদী। চন্দ্রযান মাটি ছোঁয়ার পর স্ক্রিন জুড়ে শুধু তিনি। তাতে ইসরোর বিজ্ঞানীদের উল্লাসের ছবিও ঢাকা পড়ে গিয়েছে।

এ নিয়ে বিরোধীরা কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। একটি ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আনন্দবাজার অনলাইন অবশ্য তার সত্যাসত্য যাচাই করেনি। ভিডিয়োটিতে সম্ভবত একটি চ্যানেলের দফতরের। সেখানে কোনও ব্যক্তিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘মোদীকে নয়, ইসরোর বিজ্ঞানীদের দেখাও।’’

যে ভাবে চন্দ্রযান চাঁদের মাটিতে অবতরণের মিনিট দশেক আগে মোদী সরাসরি সম্প্রচারের স্ক্রিনে চলে এলেন, যে ভাবে বাকি সময়টা চোখেমুখে গভীর উদ্বেগ নিয়ে তিনি চন্দ্রযানের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যে ভাবে অবতরণের পর তাঁর মুখে তৃপ্তি এবং স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল, যে ভাবে সেই হাসি গর্বের হাসিতে পরিণত হল এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছোট্ট জাতীয় পতাকা নড়াচড়া শুরু করল, তাতে পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট।

তার পরে প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা। তার পরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তিনি মোবাইল ফোনে ইসরোর কর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, এমন ছবিও সমাজমাধ্যমে ঘুরছে। যে সূত্রে ইতিমধ্যেই এই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে যে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে চাঁদের কুমেরুতে চন্দ্রযান পাঠানোয় ইসরোর কৃতিত্বের দাবিদার হবে বিজেপি। এই অভিযান নিয়েও ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ প্রচার চলবে।

বিরোধীদের বক্তব্য, তেমনই হবে। তাঁদের দাবি, ২০১৬ সালে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর সাফল্যকে বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদীর কৃতিত্ব’ বলে প্রচার করেছিল। গত বছর ভারত জি-২০ সম্মেলনের দায়িত্ব পাওয়ায় তাকেও একই ভাবে মোদীর জন্যই ‘সম্ভব’ বলে প্রচার করছে গেরুয়া শিবির। ফলে চন্দ্রযানের সাফল্য যে আসলে বিজেপি সরকার তথা মোদীর সাফল্য বলে তারা প্রচার করবে, তা নিয়ে খুব একটা সংশয়ের অবকাশ দেখা যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন, শুরুটা মোদীই করে দিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যায় ভাষণ দিয়ে মহাকাশের সাফল্যকে রাজনীতির মাটিতে ‘সফ্‌ট লঞ্চ’ করিয়ে দিয়েছেন। এর পর দল ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সে কাজ ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। বুধবার রাজ্য বিজেপি দফতরে নেতারা দল বেঁধে দেখেছিলেন চন্দ্রযানের শেষ বেলার সফর। সেই অভিযান সফল হতেই স্লোগান ওঠে— ‘ভারতমাতা কি জয়।’ বৃহস্পতিবার বিধানসভায় মোদীর কৃতিত্ব দাবি করেই ফেলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিধানসভায় ইসরোর সাফল্য নিয়ে অভিনন্দন জানাতে প্রস্তাব আনা হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কিছুটা অভিযোগের সুরেই বলেন, ‘‘একটাই দুঃখ রয়ে গেল। একেবারে শেষ মুহূর্তের ল্যান্ডিংটা দেখতে দেওয়া হল না। তখন অন্য জিনিস দেখতে হল।’’ নাম না করে তিনি যে স্ক্রিন জুড়ে মোদীর আবির্ভাবকেই কটাক্ষ করেছেন, তা স্পষ্ট।

তারই জবাব দিতে গিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি বিজ্ঞানীদের। কিন্তু যাঁর নেতৃত্বে এই সাফল্য এসেছে, সেই প্রধানমন্ত্রীকেও অভিনন্দন। কারণ, আগের চন্দ্রযান যখন ব্যর্থ হয়েছিল, তখন মোদীজি ইসরোর বিজ্ঞানীদের বলেছিলেন, ‘আবার করুন’।’’ সেই সঙ্গে চন্দ্রিমাকে আক্রমণ করে বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘ওঁরা সঙ্কীর্ণ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। শেষ মুহূর্তটা ওঁরা দেখতে পাননি। আমরা কিন্তু পেয়েছি।’’

বিতর্কে না ঢুকে ইসরোর সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত, তিনি বুধবার এক কর্মসূচিতে ইসরোকে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তবে লক্ষণীয়, সবেতেই মমতা ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অনেকে মনে করছেন, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি দ্ব্যর্থক। একদিকে ভারত। অন্য দিকে, বিরোধীদের জোট। মহাকাশচারী রাকেশ শর্মার কথা বলেছেন মমতা। মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, এখন নয়, অনেক আগে ইন্দিরা গান্ধীর সময়েই ভারত মহাকাশ গবেষণায় সাফল্য পেতে শুরু করে।

কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী আরও আগের কথা বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিস্তারিত টুইটে জানিয়েছেন, জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েই ভারতের মহাকাশ গবেষণা শুরু হয়েছিল। বুধধার রাতেই অবশ্য কংগ্রেস তাদের জমানায় ভারত মহাকাশ গবেষণায় কী কী করেছে, তার ফিরিস্তি টুইট করেছিল।

চন্দ্রযান নিয়ে রাজনৈতিক কৃতিত্ব আদায়ের লড়াই বিজেপি শুরু করেছিল জাতীয় স্তর থেকেই। চন্দ্রযান চাঁদ ছোঁয়ার পরে পরেই দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা বলেন, ‘‘ভারত নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে মোদীর নেতৃত্বে।’’ ইসোরর বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বলেন, ‘‘এই জয় আত্মনির্ভর ভারত মন্ত্রের। মোদীর অক্লান্ত চেষ্টা এবং বিজ্ঞানীদের অপার সক্ষমতা ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব ছিল না।’’ নড্ডা জানান, ইসরোর ৮৯টি স্যাটেলাইট মিশনের মধ্যে ৪৭টিই হয়েছে মোদী সরকারের আমলে। অতীতে কোনও সরকার এত উৎসাহ দেয়নি জানিয়ে তিনি এমনও দাবি করেন যে, দু’টি ইউপিএ জমানার দ্বিগুণ কাজ হয়েছে মোদীর আমলে।

নড্ডার বক্তব্যের জবাব অনেক পরে দেয় কংগ্রেস। সন্ধ্যায় রাহুল টুইটে লিখে দেন ১৯৬২ সাল থেকে দেশের মহাকাশ গবেষণা শুরু হওয়ার কথা। আর কংগ্রেসের পক্ষে টুইট করা হয় বুধবার রাত ১০টা ১২ মিনিটে। সেখানে নেহরুর হাতে ইসরোর জন্মবৃত্তান্ত থেকে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে রাকেশ শর্মার মহাকাশ যাত্রার কথা বলা হয়েছে। আবার মনমোহন সিংহের আমলে চন্দ্রযান-১, মঙ্গলায়ন মিশনের বিস্তারিত কথাও বলা হয়েছে। একঝলকে দেখলে মনে হয় নড্ডার দাবির জবাব। যা থেকে স্পষ্ট, লোকসভা নির্বাচনে ‘চন্দ্রযানের সাফল্য’ নিয়ে দড়ি টানাটানি চলবে।

তবে বিজেপি যে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের টুইটে স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফররত জয়শঙ্কর বৃহস্পতিবার একটি টুইট করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, জোহানেসবার্গ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র হাতে দাঁড়িয়ে মোদী। পাশে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা। কাগজে প্রথম পাতার শিরোনাম ‘ইন্ডিয়াজ় মোদী আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ড’।

আরও পড়ুন
Advertisement