বাংলার সংগঠনে বিশেষ নজর কেন্দ্রীয় বিজেপির। — ফাইল চিত্র।
সাংগঠনিক তথ্যে কতটা দুধ আর কতটা জল এ বার আর গোপন করা যাবে না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে রাজ্য বিজেপিকে সব তথ্যই ‘সরল’ অ্যাপে দিতে হবে। যার ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য থেকে বুথ স্তরের সংগঠনের হাল হকিকৎ এক ক্লিকে জেনে যাবে। অতীতে কয়েকটি রাজ্যে এই পরীক্ষামূলক ভাবে অ্যাপ ব্যবহার করেছিল বিজেপি। গুজরাত, হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেও ব্যবহার হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গোটা দেশেই অ্যাপ ব্যবহার বাধ্যতামলূক হতে চলেছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিজেপি ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে। এই অ্যাপ তারই অঙ্গ। রাজ্য বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই সংগঠনের সব স্তরে অ্যাপ ব্যবহারের বার্তা চলে গিয়েছে। অনেকেই অ্যাপ ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছেন।
অ্যাপটির ডাক নাম— সরল। আসল নাম— সংগঠন রিপোর্টিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস। গোটা দেশের যাবতীয় সাংগঠনিক তথ্য একত্রে রাখার জন্যই এই অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তাতে যেমন এক লপ্তে সব রাজ্যের সাংগঠনিক চেহারার পরিচয় পাওয়া যাবে তেমনই কোনও রাজ্য কোনও তথ্য ভুল দিচ্ছে কি না সেটাও সহজে বোঝা যাবে। বাংলার ক্ষেত্রে রাজ্যের সাংগঠনিক পরিস্থিতি ঠিক কেমন সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিল্লিকে দেওয়া হয় না বলে গেরুয়া শিবিরের অন্দরেই অনেকে অনেক সময়ে অভিযোগ ওঠে। ‘সরল’ ব্যবহার শুরু হয়ে গেলে তেমনটা করাও যাবে না, বলাও যাবে না।
রাজ্য নেতাদের কেউই এই অ্যাপের বিষয়ে মুখ খুলতে না চাইলেও গেরুয়া শিবিরের একাংশের দাবি, এই অ্যাপ তৈরির পিছনে মূল লক্ষ্য দলের উপর থেকে নীচকে এক সুতোয় বেঁধে রাখা। দল কোথায় কী কর্মসূচি নিচ্ছে, কেন সেই অভিযান সব বিষয়েই তথ্য পাওয়া যাবে এই অ্যাপ থেকে। কোন বিষয়ে সাধারণ মানুষের সামনে কোন কোন বিষয় তুলে ধরতে হবে সেটাও ‘সরল’-এর মাধ্যমে সরল হয়ে যাবে। অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনে এই অ্যাপ ডাউনলোড করার পরে সেখানে বিজেপি সদস্যদের ফোন নম্বর দিয়ে লগ ইন করতে হবে। বিজেপির সদস্যপদ নিতে গেলেই ফোন নম্বর দিতে হয়। ফলে সবার নম্বরই দলের কেন্দ্রীয় সার্ভারে রয়েছে। সেই হিসাবে লগ ইন করতে গেলেই ফোনে ‘ওটিপি’ আসবে। এর পরে নিজস্ব ‘ইউজার আইডি’ এবং ‘পাসওয়ার্ড’ তৈরি করে নিতে হবে। এর পরে যে কোনও কর্মী যেমন দল সম্পর্কে তথ্য পেতে পারবেন তেমন কোনও কর্মসূচি হলে তা অ্যাপে ‘আপলোড’ করে দিতে পারবেন। এখনও কারও ফোন নম্বর দলের সার্ভারে না থাকলে কী করতে হবে সেই নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ‘মিসড কল’ দিতে বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বরাবরই সংগঠনকে ডিজিটাল মাধ্যমে সক্রিয় করায় গুরুত্ব দিয়েছেন। বিজেপির আইটি শাখা সব রাজ্যেই গুরুত্বপূর্ণ। এ বার কেন্দ্রীয় আইটি শাখা এমন একটি অ্যাপ তৈরি করেছে যাতে গোটা দলটাই ‘ডিজিটালাইজ়’ হয়ে যায়। এই অ্যাপে কোনও কর্মী নাম নথিভুক্ত করলেই তাঁর বুথকেন্দ্র-সহ ঠিকানা, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরি বা পেশা-সহ যাবতীয় নথি দলের কাছে চলে আসবে। এর ফলে দলে কোন শিক্ষাগত মানের বা কোন পেশার কত মানুষ রয়েছেন সেই তথ্যও পেয়ে যাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। প্রকাশ্য মুখ খুলতে নারাজ হলেও রাজ্য বিজেপির এক নেতা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন, ‘‘গোটা পৃথিবীই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল। আগামী দিনে সেই নির্ভরতা আরও বাড়বে। আর বিজেপি বর্তমানের সঙ্গে আগামীরও দল। সময়ের সঙ্গে বদলায়। সেই কারণেই এমন একটি অ্যাপ আনা হয়েছে।’’ ওই নেতার দাবি, ভোটের প্রচার বা সারাবাছর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যও কাজ করবে এই অ্যাপ। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের (বিজেপি শাসিত রাজ্যের ক্ষেত্রে) যাবতীয় প্রকল্পের বিস্তারিতও থাকবে এর মধ্যে।
‘সরল’ অ্যাপের উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নেতা যেমনটা দাবি করেছেন ততটা সরল নয় বলেই মনে করছেন গেরুয়া শিবিরের অনেকে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েই দেখা গিয়েছিল, বুথ স্তরে দলের যতটা শক্তি রয়েছে বলে রাজ্য নেতারা দাবি করেছিলেন তার সঙ্গে বাস্তবের অনেক অমিল ছিল। কিন্তু ‘সরল’ আর সেটা হতে দেবে না। খুব তাড়াতাড়ি বিজেপি দেশ জুড়ে ‘বুথ সশক্তিকরণ’ কর্মসূচি নিতে চলেছে। তার আগে সব কর্মীকে অ্যাপ ‘ডাউনলোড’ করতে বলা হয়েছে। ফলে কোন বুথে কত জনের কাছে অ্যাপ রয়েছে তা দেখেই এক নিমেষে বোঝা যাবে বুথস্তরে দলের শক্তি ঠিক কেমন।
গেরুয়া শিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, এই রাজ্যে সব বুথে কমপক্ষে ১১ জনের কমিটি গড়তে বলা হয়েছে। সেই কমিটিতে স্থানীয় সব সম্প্রদায়, জনজাতি এবং উপজাতির প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে। ভোটার লিস্টের প্রতিটি পাতার জন্য এক জন পৃষ্ঠা প্রমুখ রাখতে হবে। এলাকা অনুযায়ী ৪ থেকে ৬টি বুথ নিয়ে তৈরি করতে হবে শক্তিকেন্দ্র। তার আলাদা কমিটি হবে। এর উপরে মণ্ডল কমিটি। প্রতিটিতেই কারা এবং কত সদস্য থাকবেন তা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কার কী কাজ হবে সেটাও নির্ধারিত। এখন সেই লক্ষ্যে রাজ্য বিজেপি কতটা এগোতে পারল তার সব বিবরণই থাকবে ‘সরল’ অ্যাপে। আর সেই কারণেই ‘সরল’ আসলে ততটা সরল নয়।