প্রাকৃতিক কারণে ভূগর্ভ ফোঁপরা হচ্ছে। অপরিকল্পিত ‘উন্নয়ন’ বাড়িয়ে তুলছে বিপদ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে হেলে পড়া বহুতল। হাওড়ার বেলগাছিয়ায় ভাগাড়ের চাপে মাটি ধসে বিপর্যয়। গঙ্গার দুই তীরে দুই যমজ শহরের তলার মাটির হাল নিয়ে চিন্তা বাড়ছে। চিন্তিত ভূবিজ্ঞানীরাও। হাওড়াকাণ্ডের পর কলকাতা পুরসভাও তাদের ভাগাড়-এলাকা নিয়ে বৈঠক করেছে। এখানেও যাতে বেলগাছিয়ার পরিস্থিতি না-হয়, তার জন্য পরিকল্পনা শুরু করেছে।
তবে ভূবিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হল কলকাতা এবং হাওড়ার গঙ্গাতীর থেকে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা। এক গবেষণাপত্রে কয়েক বছর আগে এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছিলেন ভূবিজ্ঞানী সুজীব কর। দুই শহরেই মাটির তলায় বেশ কিছু ‘প্রাকৃতিক রন্ধ্র’ তৈরি হয়েছে বলে তিনি গবেষণাপত্রে দাবি করেছিলেন। সুজীবের কথায়, ‘‘বৃষ্টির জল মাটির নীচে নামার সময় উল্লম্ব ভাবে নামে। তাতে ভূস্তরের বিন্যাসের কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তরে সেই ‘ডায়রেক্ট রিচার্জ’ কম হয়। ফলে কলকাতার মাটির তলার জলস্তর নেমে গিয়ে ভূগর্ভ ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আশপাশের অপেক্ষাকৃত আর্দ্র এলাকা থেকে ভূগর্ভস্থ জল কলকাতার ভূগর্ভ নিজের দিকে টানার চেষ্টা করে। সেই জল মাটির তলা দিয়ে কোনাকুনি ভাবে যাতায়াত করে বেশ কিছু ভূগর্ভস্থ চ্যানেল তৈরি করে ফেলেছে। ওই চ্যানেলগুলো এক দিকে বাগজোলা খাল, অন্য দিকে গঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। চ্যানেলগুলি দিয়ে পলি বেরিয়ে গিয়ে গঙ্গায় পড়ছে। এই ঘটনা দীর্ঘ দিন ধরে ঘটছে। জোয়ারের সময়ে ওই চ্যানেলগুলি দিয়েই আবার গঙ্গার জল ভিতরে ঢুকছে। রন্ধ্রগুলিকে আরও প্রশস্ত করে মাটিকে ক্রমশ আরও ফাঁপা করে তুলছে।’’
উপর থেকে কলকাতার মানচিত্র এমনই। কিন্তু মাটির নীচের মানচিত্রেই বিপদ লুকিয়ে। মনে করছেন ভূবিজ্ঞানীদের একাংশ।
আর এক ভূবিজ্ঞানী তথা সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ পৃথ্বীশকুমার রায় ধসের অন্য কিছু কারণও ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যেখানে ভূত্বক মূলত পলিমাটির স্তরে তৈরি, সেখানে সব সময় ভূগর্ভস্থ জলস্তরের নির্দিষ্ট একটা সীমা বহাল থাকা জরুরি। জলস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে নেমে গেলেই ভূগর্ভে বিন্যাস বদলে যায়। মাটির গভীরে চাপ বাড়তে থাকে। ফলে ধসের প্রবণতা বাড়ে।’’ হাওড়ার বেলগাছিয়ার ক্ষেত্রে পৃথ্বীশের ব্যাখ্যা, ‘‘ওখানে যেহেতু বিরাট ভাগাড় রয়েছে, তাই ইঁদুর, ছুঁচো, বেজির মতো প্রাণীর আনাগোনা বেশি। তারা মাটি খুঁড়ে ভূগর্ভে অনেক ফাঁকা জায়গা তৈরি করেছে। আর আবর্জনার স্তূপ থেকে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাস ভূগর্ভের ফাঁপা স্তরে জমে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ওই গ্যাস জমতে জমতে যদি বিস্ফোরণ ঘটায়, তা হলে আরও বড় ধস নামতে পারে।’’
বেলগাছিয়া ভাগাড়ে জঞ্জালের স্তূপ বহু বছর ধরে বাড়তে বাড়তে ভূস্তরে চাপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, বড় এলাকা জুড়ে ধস নেমেছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। স্থানীয়দের অনেককে অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে সরানো হয়েছে। ধসের জেরে জলের পাইপও নষ্ট হয়েছে। ফলে জলের সঙ্কট তৈরি হয়েছে হাওড়া শহরের একাংশে। সুতরাং জনবহুল শহরে ধস নামলে কতটা বড় বিপর্যয়ের চেহারা নিতে পারে, তা বেলগাছিয়ার ঘটনায় আরও একবার স্পষ্ট। কিন্তু এই পরিস্থিতি কলকাতার গঙ্গা লাগোয়া এলাকাতেও যে কোনও দিন তৈরি হতে পারে বলে ভূবিজ্ঞানীরা ফের সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। গঙ্গার দু’ধারে এখন কোন কোন এলাকা সবচেয়ে বেশি বিপদে, সে কথাও তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড় সংলগ্ন এলাকায় কয়েক দিন আগে যে ধস নেমেছে, তাতে মিথেন গ্যাস বা তার বিস্ফোরণের কোনও ভূমিকার কথা প্রশাসনের তরফে বলা হয়নি। কিন্তু আবর্জনার স্তূপ বা ভাগাড় যেখানেই থাকে, সেখানেই যে মিথেনের স্তর তৈরি হয়, সে বিষয়ে ভূবিজ্ঞানীরা সহমত। পৃথ্বীশের কথায়, ‘‘কলকাতার ধাপা সংলগ্ন এলাকাতেও মিথেনের বিরাট ভান্ডার ছিল। যাঁরা ইএম বাইপাস তৈরি হতে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, সে সময়ে পার্ক সার্কাস কানেক্টর ধরে যেতে হলে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে যেতে হত। না হলে মিথেনের চড়া গন্ধ নাকে এসে লাগত। এখনও সায়েন্স সিটির কাছে মিথেনের স্তর রয়েছে। তবে ধাপার ভাগাড় যে হেতু জনবহুল এলাকা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই বিপদ কমে গিয়েছে। ওই ভাগাড় এখন ক্রমশ বিদ্যাধরী এবং বাগজোলা খালের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলেও মাটির নীচে মিথেনের বিস্ফোরক স্তর তৈরি হওয়া সম্ভব। কিন্তু ওই সব এলাকা যে হেতু জনবিরল, তাই বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা নেই।’’
গঙ্গার পশ্চিমে বালি-উত্তরপাড়া এলাকা এবং পূর্বে দক্ষিণেশ্বর থেকে বরাহনগর, কাশীপুর, শোভাবাজার হয়ে নিমতলা ঘাট পর্যন্ত এলাকা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপন্ন বলে ভূবিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি। সুজীবের কথায়, ‘‘নদী তীরবর্তী এলাকায় মাটির নীচে প্রাকৃতিক রন্ধ্র তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা।’’ পৃথ্বীশ বলছেন, ‘‘সেই ফোঁপরা মাটিতে বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলেছে নিয়ম ভাঙা নগরায়ন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতা-হাওড়ার মাঝখান দিয়ে গঙ্গা সোজাসুজি বয়ে যায়নি। বাঁক বা বাঁকের প্রবণতা দৃশ্যতই রয়েছে। সেই সব বাঁককে ভেঙে দিয়ে অপেক্ষাকৃত সোজা রাস্তা খুঁজে নেওয়া যে কোনও নদীর প্রবণতা। ফলে জোয়ারের সময়ে জলস্তর বাড়লেই বাঁকপ্রবণ এলাকার পারগুলিতে জল একনাগাড়ে ধাক্কা মারতে থাকে। সেই ধাক্কায় পারের মাটির তলায় অনেক দূর পর্যন্ত জল ঢোকে এবং ক্ষয় হয়। তাই নদীর পারে কোনও বড় নির্মাণ থাকা উচিত নয়।’’ কিন্তু বালি-উত্তরপাড়া এলাকায় গঙ্গাপারের গায়েই বড় বড় বহুতল আবাসন উঠেছে। সে সব আবাসন অচিরেই বিপন্ন হতে চলেছে বলে পৃথ্বীশের দাবি। উত্তর কলকাতাতেও গঙ্গাতীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় এই বিপদ ঘনিয়ে উঠেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। নদী সংলগ্ন অনেক পুরনো নির্মাণ বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে বলে তাঁর মত।
এই পরিস্থিতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কী ভাবে? ভূবিজ্ঞানী সুজীব বলছেন, ‘‘জোয়ারের সময়ে গঙ্গার জল মাটির ভিতরে ঢোকা আটকাতে হবে। তার জন্য গার্ডওয়াল তৈরি করা ছাড়া আর কোনও উপায় আমার মাথায় আসছে না।’’ গঙ্গার পার বরাবর মাটির নীচে ২০-২২ মিটার গভীর পর্যন্ত প্রাচীর বা গার্ডওয়াল তৈরি করে জল ঢোকা আটকানো দরকার বলে তাঁর মত। কলকাতা এবং হাওড়ার মতো পুরনো শহরে গঙ্গাতীরবর্তী এলাকা অত্যন্ত জনবহুল। এই সব এলাকায় মাটির উপরে যে চাপ তৈরি হয়েছে, ভূগর্ভ ক্রমশ ফোঁপরা হতে থাকলে, সেই চাপ ধরে রাখা সম্ভব নয় বলে সুজীব এবং পৃথ্বীশ একমত।