গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মহিলা বনাধিকারিককে মন্ত্রী অখিল গিরির শাসানি ও কুমন্তব্য করার ঘটনায় ঘনিষ্ঠ মহলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্তত তেমনটাই খবর তৃণমূল সূত্রে। দলীয় সূত্রেই খবর, বন দফতরের ওই মহিলা আধিকারিক মনীষা সাউকে ফোন করেছেন বন প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা। তাঁর সঙ্গে কথা বলে গোটা ঘটনা সম্পর্কে জেনেছেন। মহিলা অফিসারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষও।
কাঁথিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মতো ‘বেআইনি দখলদার’ উচ্ছেদ করতে গিয়ে অখিলের বাধার মুখে পড়েছিলেন বনকর্মীরা। সেই সময় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের মধ্যে ওই মহিলা অফিসারকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিতে শোনা যায় রামনগরের বিধায়ক তথা কারামন্ত্রী অখিলকে। তিনি বলেন, ‘‘আপনার আয়ু ৭-৮ দিন, ১০ দিন!’’ এর আগে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ানো অখিলকে এ বার ওই মহিলা অফিসারের উদ্দেশে ‘জানোয়ার’, ‘বেয়াদব’ জাতীয় শব্দও প্রয়োগ করতে শোনা যায়। যা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। আসরে নেমেছে বিজেপিও। মন্ত্রীর এই আচরণে শাসকদলের ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা।
এই ঘটনায় তৃণমূল যে দলগত ভাবে অখিলের পাশে নেই, তা আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন কুণাল। মন্ত্রীর আচরণের নিন্দা করে তাঁর মত, বন দফতর নিয়ে কিছু বলার থাকলে অখিল বিরবাহার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তা না করে মহিলা বনাধিকারিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ‘দুর্ভাগ্যজনক’। মন্ত্রীর অমন আচরণে যে দলের সমর্থন নেই, তা শনিবার তৃণমূলের মুখপত্রের সান্ধ্য সংস্করণেও বলা হয়েছে। তৃণমূল সূত্রে খবর, কাঁথি রেঞ্জের ফরেস্ট অফিসার মনীষার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন বিরবাহা। পুরো বিষয়টা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছেন। কথায় কথায় বিরবাহা বুঝতে পেরেছেন যে, গোটা ঘটনায় মনীষা খানিক ‘ডিমরালাইজ়ড’। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে দলের অন্দরেও আলোচনা করেছেন বিরবাহা। এর পরেই মনীষার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কুণাল। তিনি মনীষাকে জানান, দল এই ঘটনাকে সমর্থন করে না। কথায় কথায় মহিলা বনাধিকারিক কুণালকে জানান, তিনি শুধু ডিউটি করছিলেন। নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন। উত্তরে কুণাল তাঁকে জানান যে, সেটা বন দফতরের নিজস্ব বিষয়। তিনি শুধু দলের কথাই বললেন। মুখ্যমন্ত্রীও ঘনিষ্ঠ মহলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন বলেই দলীয় সূত্রে দাবি।
ঘটনার সূত্রপাত শনিবার বেলার দিকে। পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুর সমুদ্রসৈকত এলাকায় বন দফতরের জায়গা থেকে উচ্ছেদ হওয়া হকারদের সমর্থনে ওই এলাকায় যান অখিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মনীষা সাউ-সহ বন দফতরের অন্য কর্মীরা। অভিযোগ, তাজপুরে বন দফতরের জমিতে দোকান বসিয়েছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সেই দোকান রাতের বেলায় গুঁড়িয়ে দেন বন দফতরের কর্মীরা। আর এতেই ক্ষুব্ধ হন অখিল। বন দফতরের মহিলা আধিকারিকের উদ্দেশে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “আপনি কত বড় অফিসার, আমি দেখে নেব।” জবাবে মহিলা অফিসার বলেন, “স্যর, আমি ডিউটি করছি বলে আমাকে তুলে দেবেন বলছেন?” পাল্টা অখিল বলেন, “আপনাকে নয়, আপনি যেখানে ডিউটি করছেন সেখান থেকে।’’ ফরেস্ট রেঞ্জার বলেন, ‘‘স্যর নাইট ডিউটি করছেন আমার স্টাফেরা।’’ ক্ষুব্ধ অখিলের উত্তর, “আপনাকে কে নাইট ডিউটি করতে বলেছে? আপনি রাত্রিবেলা কেন দোকানগুলো কাটলেন, আমি জানতে চাই।” অফিসারের সাফাই, ‘‘আমরা রাতের বেলা কিছু কাটিনি।’’
মহিলা আধিকারিকের উদ্দেশে অখিলকে এ-ও বলতে শোনা যায়, “ম্যাডাম, আপনি সবাইকে নিয়ে চলুন। না হলে বেশি দিন থাকতে পারবেন না। আপনার আয়ু ৭-৮ দিন, ১০ দিন। আমি আপনাকে বলছি। ফরেস্ট অফিসারের কী দুর্নীতি, আমি জানি। আপনাদের বিরুদ্ধে মানুষের কী অভিযোগ আছে, সব বিধানসভায় আমি ফাঁস করে দেব।” মন্ত্রী বলতে থাকেন, “আপনি এখানে থাকবেন না। ওরা (গ্রামবাসীদের দিকে ইশারা করে) সারা জীবন এখানে থাকবে। আপনি কারও কথা শুনতে চান না।’’ বিতণ্ডার মাঝেই অখিল বলেন, ‘‘২৫ ফুট আমরা নিলাম। এর ভিতরে যদি আপনি আসেন আপনি ফিরে যেতে পারবেন না। বেশি কথা বলবেন না আপনি একদম। আপনি এক জন জানোয়ার, বেয়াদব রেঞ্জার। আপনি সরকারের চাকর। মাথা নিচু করে কথা বলবেন। আপনি একদম বেয়াদবি করবেন না। আপনাকে যখন সবাই ডাঙ দিয়ে পেটাবে, তখন দেখবেন!”
বেশ কিছু সময় ধরে বাগ্বিতণ্ডার পর ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান অখিল। পরে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে অখিল বলেন, ‘‘কাঁথির ফরেস্ট রেঞ্জারের সঙ্গে আমাদের সামান্য উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। মেরিন ড্রাইভের পাশে সমুদ্রের ধারে কিছু দোকান ছিল। কিন্তু একটানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্র-ভাঙনের ফলে প্রায় ২৫টি দোকান জলের তলায় চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। তাদের দোকানের পিছনেই ফরেস্টের জায়গা ছিল। সেখানে ফাঁকা জায়গা, মেলা বসে, পর্যটকরা ওখানে এসে বসেন। বুধবার রাতে ওরা প্রাণ বাঁচাতে দোকানগুলোকে কিছুটা সরিয়ে নিয়ে যায় ফরেস্টের জায়গাতে। নদীবাঁধ সারানোর জন্য বোল্ডার ফেলা চলছিল। সেই কাজে সহযোগিতা করতেই ওরা সরে যায়।’’ গোটা ঘটনায় অখিল অবশ্য একেবারেই অনুতপ্ত নয়। তাঁর বক্তব্য, কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলেননি তিনি। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় যা ঘটার ঘটেছে। অখিল আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘অঝোরে বৃষ্টির মধ্যে গভীর রাতে দোকানগুলি করাত দিয়ে ফরেস্ট অফিসার কেটে দিয়েছেন। আমি আজ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই দোকানদারদের বসার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছি। এই ঘটনা নিয়ে অযথা জলঘোলা করার চেষ্টা হচ্ছে।’’
যদিও এই ঘটনা নিয়ে বন দফতরের ওই মহিলা আধিকারিক বিশেষ কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘‘অবৈধ ভাবে দোকান বসেছিল। তাদের বাধা দেওয়া হয়।” কিন্তু মন্ত্রীর হুমকি প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি মনীষা।