অখিল গিরি। —নিজস্ব চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মতো ‘বেআইনি দখলদার’ উচ্ছেদ করতে গিয়ে রাজ্যেরই মন্ত্রী অখিল গিরির বাধার মুখে পড়লেন বন দফতরের এক মহিলা আধিকারিক। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের মধ্যে ওই মহিলা অফিসারকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিতে শোনা গেল রামনগরের বিধায়ক অখিলকে। তিনি বলেন, ‘‘আপনার আয়ু ৭-৮ দিন, ১০ দিন!’’ এর আগে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ানো অখিলকে এ বার ওই মহিলা অফিসারের উদ্দেশে ‘জানোয়ার’, ‘বেয়াদব’ জাতীয় শব্দও প্রয়োগ করতে শোনা যায়। যা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। আসরে নেমেছে বিজেপিও।
গোটা ঘটনায় অখিল অবশ্য একেবারেই অনুতপ্ত নয়। তাঁর বক্তব্য, কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলেননি তিনি। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় যা ঘটার ঘটেছে। অখিল আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘অঝোরে বৃষ্টির মধ্যে গভীর রাতে দোকানগুলি করাত দিয়ে ফরেস্ট অফিসার কেটে দিয়েছেন। আমি আজ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই দোকানদারদের বসার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছি। এই ঘটনা নিয়ে অযথা জলঘোলা করার চেষ্টা হচ্ছে।’’
গোটা ঘটনায় অখিলের আচরণের সমালোচনা করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। তিনি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে লেখেন, ‘‘মন্ত্রী অখিল গিরির কথা এবং আচরণের বিরোধিতা করছি। এটা অবাঞ্ছিত। বন দফতর নিয়ে কিছু বলার থাকলে মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা (রাজ্যের বন প্রতিমন্ত্রী)-কে বলতে পারতেন। তার বদলে মহিলা অফিসারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্যজনক।’’ পাশাপাশিই বিরোধীদের উদ্দেশে কুণাল লিখেছেন, ‘‘তবে সিপিএম, বিজেপির এ নিয়ে বলার অধিকার নেই। ওরা এর থেকেও অনেক কুৎসিত কাজ বার বার করেছে।’’
ঘটনার সূত্রপাত শনিবার বেলার দিকে। পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুর সমুদ্রসৈকত এলাকায় বন দফতরের জায়গা থেকে উচ্ছেদ হওয়া হকারদের সমর্থনে ওই এলাকায় যান অখিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন কাঁথি রেঞ্জের ফরেস্ট অফিসার মনীষা সাউ-সহ বন দফতরের অন্য কর্মীরা। অভিযোগ, তাজপুরে বন দফতরের জমিতে দোকান বসিয়েছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সেই দোকান রাতের বেলায় গুঁড়িয়ে দেন বন দফতরের কর্মীরা। আর এতেই ক্ষুব্ধ হন অখিল। বন দফতরের মহিলা আধিকারিকের উদ্দেশে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “আপনি কত বড় অফিসার, আমি দেখে নেব।” জবাবে মহিলা অফিসার বলেন, “স্যর, আমি ডিউটি করছি বলে আমাকে তুলে দেবেন বলছেন?” পাল্টা অখিল বলেন, “আপনাকে নয়, আপনি যেখানে ডিউটি করছেন সেখান থেকে।’’ ফরেস্ট রেঞ্জার বলেন, ‘‘স্যর নাইট ডিউটি করছেন আমার স্টাফেরা।’’ ক্ষুব্ধ অখিলের উত্তর, “আপনাকে কে নাইট ডিউটি করতে বলেছে? আপনি রাত্রিবেলা কেন দোকানগুলো কাটলেন, আমি জানতে চাই।” অফিসারের সাফাই, ‘‘আমরা রাতের বেলা কিছু কাটিনি।’’
মহিলা আধিকারিকের উদ্দেশে অখিলকে এ-ও বলতে শোনা যায়, “ম্যাডাম, আপনি সবাইকে নিয়ে চলুন। না হলে বেশি দিন থাকতে পারবেন না। আপনার আয়ু ৭-৮ দিন, ১০ দিন। আমি আপনাকে বলছি। ফরেস্ট অফিসারের কী দুর্নীতি, আমি জানি। আপনাদের বিরুদ্ধে মানুষের কী অভিযোগ আছে, সব বিধানসভায় আমি ফাঁস করে দেব।” মন্ত্রী বলতে থাকেন, “আপনি এখানে থাকবেন না। ওরা (গ্রামবাসীদের দিকে ইশারা করে) সারা জীবন এখানে থাকবে। আপনি কারও কথা শুনতে চান না।’’ বিতণ্ডার মাঝেই অখিল বলেন, ‘‘২৫ ফুট আমরা নিলাম। এর ভিতরে যদি আপনি আসেন আপনি ফিরে যেতে পারবেন না। বেশি কথা বলবেন না আপনি একদম। আপনি এক জন জানোয়ার, বেয়াদব রেঞ্জার। আপনি সরকারের চাকর। মাথা নিচু করে কথা বলবেন। আপনি একদম বেয়াদবি করবেন না। আপনাকে যখন সবাই ডাঙ দিয়ে পেটাবে, তখন দেখবেন!”
বেশ কিছু সময় ধরে বাগ্বিতণ্ডার পর ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান অখিল। পরে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে অখিল বলেন, ‘‘কাঁথির ফরেস্ট রেঞ্জারের সঙ্গে আমাদের সামান্য উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। মেরিন ড্রাইভের পাশে সমুদ্রের ধারে কিছু দোকান ছিল। কিন্তু একটানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্র-ভাঙনের ফলে প্রায় ২৫টি দোকান জলের তলায় চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। তাদের দোকানের পিছনেই ফরেস্টের জায়গা ছিল। সেখানে ফাঁকা জায়গা, মেলা বসে, পর্যটকরা ওখানে এসে বসেন। বুধবার রাতে ওরা প্রাণ বাঁচাতে দোকানগুলোকে কিছুটা সরিয়ে নিয়ে যায় ফরেস্টের জায়গাতে। নদীবাঁধ সারানোর জন্য বোল্ডার ফেলা চলছিল। সেই কাজে সহযোগিতা করতেই ওরা সরে যায়।’’ অখিলের দাবি, বিষয়টি নিয়ে অথযা জলঘোলা করা হচ্ছে।
যদিও এই ঘটনা নিয়ে বন দফতরের ওই মহিলা আধিকারিক বিশেষ কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘‘অবৈধ ভাবে দোকান বসেছিল। তাদের বাধা দেওয়া হয়।” কিন্তু মন্ত্রীর হুমকি প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি মনীষা।
এই ঘটনায় বিজেপি বিধায়ক তথা বিধানসভায় বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক শঙ্কর ঘোষ বলেন, “অখিলবাবুকে তো বিধানসভায় দেখেছি। এটা ওঁদের দলীয় শিক্ষা। ফলে এই ভাবেই ওঁরা কথা বলবেন, যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন।”