অনামিকা রায়। —নিজস্ব চিত্র।
প্রথমে রিকশা। তার পরে বাস। শিলিগুড়ি শহর থেকে তাঁর কর্মস্থলের দূরত্ব এখন নয়-নয় করেও বিশ কিলোমিটার। সোম থেকে শনি জলপাইগুড়ি জেলার আমবাড়ি যেতে হয় তাঁকে। রোজ যাওয়া-আসায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সকাল ১১টায় স্কুল বসে। তার অন্তত দেড় ঘণ্টা আগে তাঁকে বেরোতে হয় শিলিগুড়ির বাড়ি থেকে।
শরৎ এসেছে। শহর থেকে গ্রামের স্কুলে যাওয়ার পথের ধারে কাশফুল ফুটেছে। প্রতি বছরই যেমন ফোটে। তবে এ বছরের কাশফুলের রং তাঁর কাছে আরও বেশি সাদা। শুভ্র। যে শুভ্রতার মানে শান্তি। এ বারের পুজো তাঁর কাছে ভিন্ন। এ বারের পুজো তাঁর কাছে শান্তির। তৃপ্তির। বাড়তি আড়ম্বর নেই। বিশেষ হইহই নেই। বাকি বছরগুলোয় পুজোর অনুষঙ্গ যেমন থাকে, এ বারও প্রায় তেমনই। ‘প্রায়’। কারণ, এ বার অন্য সব কিছুর সঙ্গে বাড়তি শান্তি আছে। একটু বাড়তি নিশ্চয়তা আছে। আর আছে যুদ্ধজয়ের আনন্দ।
যুদ্ধই বটে! আদালতের চৌহদ্দিতে, আইনের পরিধিতে যুদ্ধই করেছিলেন শিলিগুড়ির অনামিকা রায়।
আদালতের নির্দেশে সরকারি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পাওয়ার পর এ বারই প্রথম পুজো অনামিকার। আইনি লড়াইয়ে তিনি যাঁর জায়গায় নিয়োগ পাওয়ার আর্জি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, তিনি আবার নিয়োগ পেয়েছিলেন অন্য এক জনের জায়গায়। সে তিনি যে-সে ‘তিনি’ নন। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা। তাঁর নিয়োগ বাতিল করেছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পরেশ-কন্যার জায়গায় চাকরি পেয়েছিলেন ববিতা সরকার। ববিতা কয়েক মাস স্কুলে পড়িয়েও ফেলেছিলেন। কিন্তু তার পরে আদালতে তথ্য দিয়ে অনামিকা দাবি করেন, ববিতা নন, আসলে স্কুলশিক্ষিকার ওই পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা তাঁর। স্কুল সার্ভিস কমিশনের ‘বদান্যতায়’ তিনি তা থেকে বঞ্চিত।
আদালত অনামিকার মামলা শোনে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তথ্য খতিয়ে দেখে কমিশনের রিপোর্ট তলব করেন। দেখা যায়, বিসমিল্লায় গলদ করে রেখেছে কমিশনই। যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় অঙ্কিতার চাকরি বাতিল করে ববিতাকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই তিনিই ববিতার চাকরি বাতিল করে অনামিকাকে চাকরিতে নিয়োগ করার নির্দেশ দেন।
দশ হাতে না-হলেও, তাঁর জীবনও তো লড়াইয়ের। তাঁর জীবনের সেই লড়াইয়ে ‘অসুর’ কে?
কেউ নয়। কাউকে ‘অসুর’ ভাবতে চান না আমবাড়ি হরিহর উচ্চ বিদ্যালয়ে সদ্য যোগ দেওয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিদিমণি। শুধু বলেন, ‘‘অন্যায় আর দুর্নীতিকে বধ করে সত্যের জয় হয়েছে। ন্যায়ের জয় হয়েছে।’’
তাঁর জীবনে কোনও ‘দুগ্গাঠাকুর’ আছেন?
অনামিকা বলেন, ‘‘মা দুর্গার তুলনা কারও সঙ্গে করব না। তবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আমার কাছে ভগবান। ঈশ্বর। তাঁর জন্যই এ বারের পুজোটা আমার কাছে শান্তির। নিশ্চয়তার। নিশ্চিন্ততার। সব একই রয়েছে। তবু এ বারের পুজোটা আলাদা। ভিন্ন। ভিন্ন পুজো।’’
যমজ সন্তানের মা অনামিকা। তাদের বয়স এখন দু’বছর চার মাস। ছেলে শুভাং। মেয়ে আনভি। দু’জনেই দুরন্ত। বাড়ি মাথায় করে রাখে। ইদানীং ছেলেমেয়েকে আগের তুলনায় খানিকটা কমই সময় দিতে পারছেন মা অনামিকা। কারণ, তাঁকে পড়াতে যেতে হয় দূরে। শহর পেরিয়ে গ্রামে। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। শাশুড়ি রয়েছেন বাড়িতে। স্বামী শুভজিৎ বিশ্বাস একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। যিনি অনামিকার পাশে আগাগোড়া ছিলেন আইনি লড়াইয়ে। যে লড়াই করে অনামিকা তাঁর হকের চাকরি পেয়েছেন। আইনি লড়াইয়ে জিতে আদালতের নির্দেশের পরেও আটকেছিল পুলিশি যাচাই পর্ব। এই গত মাস পর্যন্তও। তার পরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আর এক প্রস্ত ভর্ৎসনা করেন কমিশনকে। অতঃপর নড়েচড়ে বসে শিলিগুড়ি কমিশনারেট। অনামিকার পুলিশি যাচাই পর্ব হয়। শেষমেশ ২১ সেপ্টেম্বর হাতে নিয়োগপত্র পেয়েছেন অনামিকা। কাজে যোগ দেন ২২ তারিখ। এখনও মাস ঘোরেনি। তাই এখনও নতুন চাকরির পারিশ্রমিক পাননি অনামিকা। সেপ্টেম্বরের ওই ক’দিনের পারিশ্রমিক ‘এরিয়ার’ হিসাবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকবে আগামী মার্চে। অক্টোবরের বেতন হাতে পেতে পেতে পুজো ফুরিয়ে যাবে। তবু ‘বেতনহীন’ পুজোও অনামিকার কাছে নিশ্চিন্তির। শান্তির।
শিলিগুড়ির দুধ মোড়ের কাছের এক আবাসনে থাকেন অনামিকা। তাঁদের ফ্ল্যাটটি বেশ সাজানো-গোছানো। পরিপাটি। যেমন ছিল গত পুজোর সময়েও। তবে গত পুজোয় তিনি ছিলেন শহরের এক বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। এখন তিনি সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। সাজানো ফ্ল্যাটটিতে বস্তুগত নতুন কিছু যোগ হয়নি। কিন্তু অনিশ্চয়তার নিম্নচাপ আর উৎকণ্ঠার ঘূর্ণাবর্ত কেটে গিয়ে ড্রইংরুমে খেলে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্ত বসন্ত। এই শরতেও।
তবে নিজে নিশ্চিন্ত হলেও অনামিকা ভুলতে পারছেন না কলকাতার রেড রোডকে। মেয়ো রোডকে। মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি, গান্ধী মূর্তির পাদদেশে চাকরিপ্রার্থীরা বসে রয়েছেন দিন-রাত, রোদ-বৃষ্টি, পুজো-ইদ এক করে। রাস্তাতেই কেটে যাচ্ছে তাঁদের সপ্তাহ, মাস, বছর। অনামিকা বলছেন, ‘‘আমি চাই ওঁরাও আমার মতো যুদ্ধটা জিতুন। ওঁরাও ওঁদের হকের চাকরি পান। ওঁদের মতোই ছিল আমার গত বারের পুজো। আমি তাই বুঝি, কী যন্ত্রণা নিয়ে, কী বিষণ্ণতা বুকে চেপে ওঁরা পুজোর সময়ে ওখানে বসে রয়েছেন।’’ খানিক থেমে স্বগতোক্তির ঢংয়ে প্রশ্ন করেন, ‘‘ওঁদের পুজো আমার পুজোর মতো হবে? কবে হবে?’’
অনামিকার আবাসনের উল্টোদিকে পূর্বাচল ক্লাবের মা দুগ্গা কি ঢাকের বাদ্যি ছাপিয়ে শুনতে পান সেই আকুল প্রশ্ন?