TMC Dharna at Delhi

‘গান্ধীগিরি’ না কি ‘জঙ্গি’ মেজাজ? ধর্না কর্মসূচি নিয়ে দু’টি মত ছিল তৃণমূলের অন্দরে, জিতেছিল ‘আমিষ’

জঙ্গি পথে আন্দোলন করা হবে না কি ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে চলে আসা হবে? তৃণমূলের অন্দরে দু’টি মত ছিল দিল্লি অভিযান নিয়ে। ঠিক হয়, সংঘর্ষমূলক আন্দোলনই করা হবে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ২১:২৩
There were differences within the party over the style of agitation program of TMC in Delhi

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

মঙ্গলবার দুপুর থেকে বেশি রাত পর্যন্ত রাজধানী দিল্লিতে কার্যত দাপিয়ে বেড়িয়েছে তৃণমূল। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত আক্রমণাত্মক বক্তৃতা এবং তার পর থেকে বিরোধী রাজনীতির ‘চেনা মেজাজ’ দেখিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। যার ফলে গভীর রাতে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে, চ্যাংদোলা করে কৃষিভবন থেকে বার করে এনে বাসে তোলে পুলিশ। তার পরে নিয়ে যায় থানায়।

Advertisement

রাতেই ‘পুলিশি নিগ্রহে’র অভিযোগ করেন অভিষেক এবং তাঁর সহ-আন্দোলনকারীরা। রাতেই সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গোটা ঘটনার ‘ফুটেজ’ এবং ছবি পৌঁছে যায়। অভিষেকদের কী ভাবে টেনে তুলে বার করে দেওয়া হচ্ছে, তৃণমূলের পুরুষ এবং মহিলা সাংসদদের এবং রাজ্যের মন্ত্রীদের কয়েকজনকে কী ভাবে চ্যাংদোলা করে বার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে ছবিও সমাজমাধ্যম-সহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

গোটা ঘটনাপ্রবাহে তৃণমূলের যে ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ হয়েছে, একান্ত আলোচনায় তা মেনে নিচ্ছেন রাজ্য বিজেপির নেতারাও। আর তৃণমূলের নেতারা বলছেন, জঙ্গি আন্দোলন করায় ওই ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ পাওয়া গিয়েছে। তাঁরা যদি অবস্থান-ধর্নায় বসে না-পড়তেন, তা হলে দিল্লি পুলিশ তাঁদের মন্ত্রীর দফতর থেকে জোর করে তুলে দিত না। আর গোটা দেশে তাঁদের সাংসদদের ‘হেনস্থা’র কথাও প্রচারিত হতে পারত না।

প্রসঙ্গত, তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ শান্তনু সেনকে যে ভাবে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাতে তাঁর কোমরে চোট লেগেছে। বুধবার থেকে ফিজিয়োথেরাপি শুরু করতে হয়েছে। সেই ছবি প্রকাশ্যে এনেছেন শান্তনু। লোকসভার সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে মহিলা পুলিশ চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে— এমন ছবিও সমাজমাধ্যমে ঘুরছে। যা থেকে গুরুত্ব তো বটেই, সহানুভূতিও পাচ্ছে তৃণমূল। বাংলার জনতা দেখছে, তৃণমূলের সংসদ-মন্ত্রী-নেতানেত্রীরা বঞ্চিত মানুষের বকেয়া আদায়ের জন্য পুলিশের হাতে হেনস্থা হচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, তৃণমূল সূত্রের খবর, কোন পথে মঙ্গলবারের আন্দোলন হবে, তা নিয়ে সোমবার প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লির বাড়িতে বৈঠকে দু’টি অভিমত শোনা গিয়েছিল। দলের একটি অংশ চেয়েছিল, প্রশাসনের সঙ্গে কোনও সংঘাতে না গিয়ে কৃষিভবনে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে বেরিয়ে আসা হোক। কিন্তু অন্য একাংশ দাবি তোলে, বিরোধী আন্দোলন করতে হলে কোনও রকম ‘গান্ধীগিরি’ করলে চলবে না। সেটা ‘জঙ্গি মেজাজে’ই করতে হবে। নইলে তার কোনও রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকবে না।

অসমর্থিত সূত্রের খবর, রাজ্যের কোনও কোনও মন্ত্রী চেয়েছিলেন, গোলমাল না-করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে বেরিয়ে এলেই ভাল। তবে একজন মন্ত্রী শুরু থেকেই জঙ্গি আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একাংশ অধিকাংশ মন্ত্রীর প্রস্তাবের বিষয়ে প্রকাশ্যেই আপত্তি জানান। তাঁরা বলেন, দলকে আন্দোলনের রাস্তায় থাকতে হবে। আর সেই আন্দোলন সংঘর্ষের (কনফ্রন্টেশন) না হলে তা করে কোনও লাভ নেই। এক প্রবীণ সাংসদ বৈঠকে এমনও বলেন যে, ‘গান্ধীগিরি’ করে কোনও লাভ নেই। বিরোধী হিসেবে তৃণমূল বরাবর রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেই এই জায়গায় পৌঁছেছে। ফলে বিরোধী ভূমিকা পালন করতে গেলে তৃণমূলকে তাদের ‘স্বাভাবিক’ ভূমিকাতেই থাকতে হবে। যে হেতু গ্রামীণ মানুষের রুটিরুজি নিয়ে আন্দোলন, তাই তার মেজাজও তেমনই হওয়া দরকার। বৈঠকে এমন কথাও হয় যে, ‘সরকারি মানসিকতা’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মন্ত্রীরা তাতে রাজিও হয়ে যান। শেষপর্যন্ত তাঁরাও একমত হন যে, সরকারে থাকার মানসিকতা সরিয়ে রেখেই বিরোধী আন্দোলনে নামা জরুরি। না হলে তা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তখন ঠিক হয়, সীমানার মধ্যে থেকেই সংঘর্ষ এবং জঙ্গি আন্দোলনের পথে যাওয়া হবে। ‘নিরামিষ’ নয়, ‘আমিষ’ আন্দোলন করা হবে। মন্ত্রী ঘরের সামনে প্রয়োজনে ধর্না-অবস্থানে বসা হবে। বাস্তবেও তেমনই ঘটে মঙ্গলবার রাতে।

তার আগে মঙ্গলবার দুপুরে যন্তর মন্তরে ধর্না-অবস্থানে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট ছিল যে, তৃণমূল জঙ্গি আন্দোলনের রাস্তাতেই যাবে। ফিরহাদ বলেছিলেন, ‘‘একটা সময়ে সিপিএমের পুলিশ আমাদের মারত। তার পর সেই পুলিশই এখন আমাদের স্যালুট করে। ১২ বছর এ সব দেখিনি। দিল্লিতে এসে দেখলাম। এক দিন এই দিল্লি পুলিশকেও আমাদের স্যালুট করতে হবে।’’

তৃণমূল সূত্রের খবর, পুলিশ যখন তাঁদের কৃষিভবন থেকে জোর করে বার করে বাসে তুলে দিচ্ছে, তখন ফিরহাদ দলীয় সতীর্থদের কাছেও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বলেন, পুরোন দিন মনে পড়ে যাচ্ছে। বস্তুত, বুধবার কলকাতায় ফিরেও তিনি বলেন, ‘‘অনেকদিন পর বেশ একটা আন্দোলনের উত্তেজনা পাওয়া গেল!’’

যা থেকে অনেকে এমনও মনে করছেন যে, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধী হিসেবে তৃণমূল জঙ্গি আন্দোলন এহং সংঘর্ষের পথেই যাবে। ‘গান্ধীগিরি’ গান্ধীজয়ন্তীতে রাজঘাটে মৌনী প্রতিবাদেই শেষ হয়ে গিয়েছে।

Advertisement
আরও পড়ুন