ট্যাব দুর্নীতির তদন্তে নেমে হতভম্ব তদন্তকারীরা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
কেউ পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা। কেউ আবার মালদহ। কেউ উত্তর দিনাজপুরের। সকলের পেশাও ভিন্ন। কেউ কৃষক। কেউ চা-বাগানের শ্রমিক। কেউ আবার লটারির টিকিট বিক্রি করে দিন গুজরান করেন। তালিকায় রয়েছেন গৃহশিক্ষকও! প্রত্যেকের পেশা, ঠিকানা আলাদা আলাদা হলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মিল রয়েছে একটি বিষয়ে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের এলাকায় ‘কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ’ বলে পরিচিত। ট্যাব দুর্নীতির তদন্তে নেমে সন্দেহভাজনদের সেই তালিকা দেখে কার্যত হতভম্ব তদন্তকারীরা। তবে তাঁদের অনুমান, গোটা জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে শিক্ষা দফতরের কিছু কর্মীর যোগ থাকাও অসম্ভব নয়। শুধু তা-ই নয়, দুর্নীতিচক্র ভিন্রাজ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ।
ট্যাব কেনার জন্য ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ১০ হাজার টাকা করে দেয় রাজ্য সরকার। স্কুল কর্তৃপক্ষই পড়ুয়াদের নাম-সহ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরের তালিকা শিক্ষা দফতরে পাঠান। সেই মতো পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়। সম্প্রতি অভিযোগ উঠতে শুরু করে, বহু পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়েনি এ বার। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অনেক পড়ুয়ার টাকা অন্যের অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সেই টাকা তুলেও নেওয়া হয়েছে। তদন্তে নেমে সাইবার দুর্নীতির হদিস পান তদন্তকারীরা।
কী ভাবে হল জালিয়াতি? তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই জালিয়াতি হয়েছে বিভিন্ন সাইবার ক্যাফে থেকে। সাইবার ক্যাফের মালিকদের সঙ্গে কাজের সূত্রে স্থানীয় স্কুলগুলির যোগাযোগ নতুন কিছু নয়। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরেই বিভিন্ন স্কুলের ‘লগ-ইন ক্রেডেনশিয়ালস’ (মূলত ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড) রাখা থাকে সাইবার ক্যাফের মালিকদের কাছে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের ‘লগ ইন ক্রেডেনশিয়ালস’ ব্যবহার করে পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর বদলে দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ‘সিস্টেম জেনারেটেড’ সমস্যার কারণে অ্যাকাউন্ট নম্বর বদলানো যায়নি। সেই সময় সাইবার প্রতারকদের সাহায্য নিয়ে বদলে দেওয়া হয় আইএফএসসি নম্বর। যার ফলে অ্যাকাউন্ট নম্বর এক থাকলেও টাকা চলে গিয়েছে অন্যের অ্যাকাউন্টে। এ ভাবেই রাজ্যের পাঁচ-ছ’টি জেলা মিলিয়ে দু’হাজারেরও বেশি পড়ুয়ার ট্যাব কেনার টাকা হাতিয়েছে প্রতারকেরা।
তদন্তকারীদের অনুমান, জালিয়াতির জন্য ভিন্রাজ্যের সাইবার প্রতারকদেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে এ ক্ষেত্রে। বিহারের কিষানগঞ্জ থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুর-সহ একাধিক শহরে এই দুর্নীতির চক্র ছড়িয়ে রয়েছে। মূলত আইএফএসসি নম্বর বদলাতেই তাঁদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ।
ট্যাব দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়েছে প্রশাসন। প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষা দফতরের ভূমিকা নিয়েও। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশেই রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার-সহ অন্য আধিকারিকদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই বৈঠক করেছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তদন্তে নেমে পুলিশের জালে ধরা পড়েছেন বর্ধমানের এক বাসিন্দা। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মালদহ ও দিনাজপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় আরও চার জনকে। উত্তরবঙ্গ থেকেও ট্যাব দুর্নীতিকাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছে চা-বাগানের এক শ্রমিক এবং এক কৃষককে। এ ছাড়াও মালদহ থেকে গ্রেফতার করা হয় ভগবানপুর কেবিএস স্কুলের চুক্তিভিত্তিক এক কম্পিউটার শিক্ষককে।
কলকাতার একাধিক থানাতেও জালিয়াতির অভিযোগ দায়ের হয়েছে। প্রথমে যাদবপুর ও ঠাকুরপুকুরের দু’টি করে স্কুল থেকে এই অভিযোগ উঠে এসেছিল। বুধবার রাতে জানা যায়, আরও তিনটি নতুন অভিযোগ দায়ের হয়েছে কলকাতায়। ওয়াটগঞ্জ থানা, মানিকতলা থানা এবং বেনিয়াপুকুর থানায় অভিযোগ জমা পড়েছে। এই নিয়ে কলকাতায় মোট ৬টি থানায় অভিযোগ দায়ের হল। যাদবপুর থানায় ১২টি, ঠাকুরপুকুর থানায় ৩১টি, কসবা থানায় ১০টি, ওয়াটগঞ্জ থানায় ২টি, মানিকতলা থানায় ২টি এবং বেনিয়াপুকুর থানায় ৫টি অভিযোগ জমা হয়েছে।
ট্যাব দুর্নীতির জন্য রাজ্য প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুলছে বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডলের কথায়, “এত সংখ্যক ‘ফেলড ট্রানজ়াকশন’ হল কী করে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এর জন্য তো স্কুল বা জেলা স্কুল পরিদর্শকের দফতরকে দায়ী করা যাবে না। এর জন্য দায়ী অর্থ দফতর ও শিক্ষা দফতর।”
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারীর সন্দেহ ট্যাবের টাকা ঘিরে কোনও দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে। তাঁর বক্তব্য, “স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে এফআইআর না করে, প্রকৃত তদন্ত করা হোক।”