এখনও পর্যন্ত রাজ্যের অন্তত ১৫টি জেলায় ছড়িয়েছে ট্যাব কেলেঙ্কারি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সাম্প্রতিক কালে নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। ট্যাব-কাণ্ডে সেই রাজ্য সরকারই এ বার ‘দুর্নীতি’র শিকার! এখনও পর্যন্ত রাজ্যের অন্তত ১৫টি জেলায় ছড়িয়েছে ট্যাব কেলেঙ্কারি। পড়ুয়াদের জন্য রাজ্যের বরাদ্দ লক্ষ লক্ষ টাকা পৌঁছে গিয়েছে সাইবার অপরাধীদের হাতে। তা প্রকাশ্যে আসার পর কলকাতায় একাধিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, ট্যাব জালিয়াতি চক্রের আঁতুড়ঘর উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া এবং তার আশপাশের এলাকা। শুধু তা-ই নয়, গোটা চক্রের মাথা এক জন বলেই আপাতত মনে করছেন লালবাজারের তদন্তকারীরা। বৃহস্পতিবার রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ১০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ন্যাশনাল ইনফরমেটিকস সেন্টার আমাদের ইতিমধ্যে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) জমা দিয়েছে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র যে ভাবে বাইরে আসা আটকানো গিয়েছে, এই বিষয়টিরও সম্পূর্ণ সমাধান হবে।’’
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ট্যাব কিনতে ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে পড়ুয়াদের ১০ হাজার টাকা করে দেয় রাজ্য সরকার। তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর ২০২১ সালে এই প্রকল্প চালু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে শুধু দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদেরই এই টাকা দেওয়া হত। এ বছর একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদেরও ট্যাব কেনার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিয়ম হল, স্কুল কর্তৃপক্ষই পড়ুয়াদের নাম-সহ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরের তালিকা শিক্ষা দফতরে পাঠাবে। সেই মতো পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে ট্যাবের টাকা জমা হবে। এই বছর অভিযোগ ওঠে, বহু পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমাই পড়েনি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তাদের টাকা চলে গিয়েছে অন্যের অ্যাকাউন্টে। এর তদন্তে নেমে সাইবার অপরাধীদের যোগসাজশের হদিস পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
ট্যাব কেলেঙ্কারির প্রথম অভিযোগ উঠেছিল পূর্ব বর্ধমানে। ধীরে ধীরে একই অভিযোগ উঠতে শুরু করে অন্যান্য জেলায়। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, ১৫টি জেলার মোট ১৯৪টি স্কুলের পড়ুয়ারা ট্যাব কেলেঙ্কারির শিকার। বাকি আট জেলা থেকে এখনও সেই রকম কোনও অভিযোগ প্রকাশ্যে আসেনি। তবে প্রশাসনিক আধিকারিকদের একাংশের মত, ট্যাব কেলেঙ্কারি যে ভাবে ছড়িয়েছে, তাতে ওই আট জেলাও তালিকায় যুক্ত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
রাজ্য পুলিশ জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ৭৮১ জন পড়ুয়া ট্যাব কেলেঙ্কারির শিকার হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছে। জেলাভিত্তিক হিসাবে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে এখনও পর্যন্ত ১৩৫২ জন পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে ট্যাবের টাকা ঢোকেনি। ট্যাব-কাণ্ডে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার দক্ষিণ ২৪ পরগনার পড়ুয়ারা। সেখানে ৪৯টি স্কুলের ৩৫০ জন পড়ুয়া ট্যাবের টাকা পায়নি বলে অভিযোগ। পূর্ব মেদিনীপুরেও ৩৮টি স্কুলের ২৪০ জন পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকেনি। কলকাতায় এখনও পর্যন্ত ১০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। হয়রানির শিকার হয়েছে ন’টি স্কুলের সব মিলিয়ে ১০৭ জন পড়ুয়া । তদন্তে নেমে লালবাজার জানতে পেরেছে, ট্যাব কেলেঙ্কারির টাকা যে সব অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, সেগুলি ভাড়া নেওয়া অ্যাকাউন্ট। ৩০০ থেকে অন্তত পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে সেই সব অ্যাকাউন্ট ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকার এক-দু’ঘণ্টার মধ্যেই তা তুলে নেওয়া হয়। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, টাকা তোলার আগে কিছু অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছিল। ‘ফ্রিজ়’ও করা হয়েছিল কিছু অ্যাকাউন্ট।
লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, ভাড়ার অ্যাকাউন্টগুলির মালিকেরা মূলত উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। সেই সূত্রেই উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার নাম এসেছে। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, চোপড়া গোটা চক্রের আঁতুড়ঘর। সেখান থেকে ইতিমধ্যেই চার জনকে গ্রেফতার করেছে রাজ্য পুলিশ। তাঁদের এক জন স্থানীয় তৃণমূল নেতার ছেলে। লালবাজার আরও ছ’জনের খোঁজ করছে। তাঁরা পলাতক। সিট গঠন করে ট্যাব কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে কলকাতা পুলিশ। মালদহ জেলা পুলিশও একটি সিট গঠন করেছে।
ট্যাব-কাণ্ডে কী করছে রাজ্য সরকার
ট্যাব কেলেঙ্কারির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই স্বাভাবিক ভাবে অস্বস্তিতে পড়েছে রাজ্য প্রশাসন। প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষা দফতরের ভূমিকা নিয়েও। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার-সহ অন্যান্য আধিকারিকের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। ট্যাব জালিয়াতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে রাজ্য জুড়ে ইতিমধ্যেই ১০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘যে সব পড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকেনি, তাদের মধ্যে অন্তত ১০০ জনকে আবার টাকা দেওয়া হয়েছে ট্যাব কেনার জন্য।’’ প্রশাসনিক সূত্রে খবর, হয়রানির শিকার হওয়া বাকি পড়ুয়াদেরও ট্যাব কেনার টাকা দিয়ে দেওয়া হবে, ‘উধাও’ হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধার হওয়ার আগেই। শুধু তা-ই নয়, এ বার থেকে ট্যাব প্রকল্পে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর ভান্ডারকে ‘মডেল’ হিসাবে অনুসরণ করার পরামর্শও শিক্ষা দফতরকে দিয়েছে নবান্ন। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার মুখ্যসচিবের বৈঠকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকে শিক্ষা দফতরকে বলা হয়েছে, আগামী বছর থেকে ট্যাবের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে একটিও বেনিয়মের ঘটনা না ঘটে, সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কারণ, প্রত্যেক প্রকল্পের অর্থ দেওয়ার উপর রাজ্য সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ নির্ভর করে। সেই প্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছতা’ থাকা জরুরি। কোনও প্রকল্পের অর্থ খরচে বেনিয়ম পাওয়া গেলে তার দায় বহন করতে হয় রাজ্য সরকারকেই। তাই এ ক্ষেত্রে আরও সচেতন থাকতে হবে। নবান্নের শীর্ষ আধিকারিকেরা জেনেছেন, ট্যাব কেনার টাকা দেওয়ার জন্য ‘বাংলার শিক্ষা’ পোর্টালে পড়ুয়াদের নাম নথিভুক্ত করতে হয় স্কুলগুলিকে। যে সব স্কুলে একাদশ-দ্বাদশে বৃত্তিমূলক কোর্স পড়ানো হয়, সেখানে ‘তরুণের স্বপ্ন’ নামে পৃথক একটি পোর্টালেও নাম নথিভুক্ত করা যায়। ছাত্রছাত্রীদের নাম, ব্যাঙ্কের নাম, শাখা, আইএফএসসি কোড ও অ্যাকাউন্ট নম্বর পোর্টালে দিয়ে নথিবদ্ধকরণ করতে হয়। সেখানে আধার কার্ড নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ছাত্রছাত্রীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আধার সংযুক্তিকরণ না থাকাতেই অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে টাকা দেওয়ার সময় এমন সমস্যা হয় না। সেই সূত্রেই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটিকে ‘মডেল’ হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যে হেতু নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি পরিচালনা করে, তাই অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে স্কুলশিক্ষা দফতরকে।
কোথায় হয়েছে গোলমাল?
শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, ট্যাব কেলেঙ্কারি হয়েছে মূলত বিভিন্ন সাইবার ক্যাফে থেকে। পড়ুয়াদের নাম-ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরের তালিকা বাংলা শিক্ষা পোর্টালে আপলোড করতে হয় স্কুলগুলিকে। মূলত সাইবার ক্যাফে থেকেই সেই কাজ করে বহু স্কুল। গোলমাল সেখানেই হয়েছে। শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানান, পোর্টালে তথ্য আপলোড করার কাজ অনেক সময় প্রধানশিক্ষকেরা নিজেই করেন। আবার অন্য কাউকেও এই দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তার কাছে থাকে প্রয়োজনীয় ‘লগ-ইন ক্রিডেনশিয়ালস’ (ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড)। ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘প্রথমে বাংলা শিক্ষা পোর্টালের তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পে লগ ইন করার জন্য একটি জেনারেল পাসওয়ার্ড-আইডি দেওয়া হয়। সমস্ত স্কুলের প্রধানশিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেই আইডি-পাসওয়ার্ড যাতে পরে তাঁরা বদলে দেন। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বহু স্কুল পাসওয়ার্ড পরিবর্তন না করে সেই পুরনো একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই পোর্টালে লগ ইন করে। সেখানেই পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য বদলে দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেই কাজ করেছে সাইবার ক্যাফের লোকেরা।’’ অন্য দিকে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক চন্দন মাইতির বক্তব্য, ‘‘পুরো কাজটি অনলাইনের মাধ্যমে করতে হয়। বহু স্কুলে এই কাজ করার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বা পরিকাঠামো নেই। বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হয় সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে। বহু সময় বাংলার শিক্ষা পোর্টালের সার্ভার ডাউন থাকায় সেখানেই কাজটি বন্ধ রেখে চলে আসতে হয়। আর সেখান থেকেই তথ্য পাচার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’’
কেলেঙ্কারি বাইরের রাজ্যেও?
ট্যাব কেলেঙ্কারিতে ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া গ্যাংয়ের যোগ থাকতে পারে বলেও দাবি করেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তিনি বলেছেন, ‘‘যেভাবে রাজ্য সরকারি স্কিমের টাকা বিহারের অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে, তাতে এর সঙ্গে জামতাড়া গ্যাংয়ের কোনও যোগাযোগ রয়েছে কি না, পুলিশ-প্রশাসন খতিয়ে দেখছে।’’ পুলিশ সূত্রেও খবর, ট্যাব জালিয়াতির জন্য ভিন্রাজ্যের সাইবার প্রতারকদেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছে। সেই ভিন্রাজ্যের ব্যাঙ্কেও ট্যাবের টাকা গিয়েছে, বিহারের কিষানগঞ্জ থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুর-সহ একাধিক শহরে এই চক্র ছড়িয়ে রয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের একাংশের।