Sudip Banerjee Tapas Roy Kunal Ghosh

নীরবতা হিরণ্ময়! দেখালেন সুদীপ, কথা বলে দল ছেড়ে দিতে হল তাপসকে, কুণাল পেলেন শো-কজ়ের চিঠি

তাপস-কুণালেরা একাদিক্রমে যাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক বোমা ফাটিয়েছেন, বিবিধ শব্দবন্ধে বিদ্ধ করেছেন, তখন একেবারে নীরব থেকেছেন প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৪ ০৮:০০
Sudip Banerjee Tapas Roy Kunal Ghosh

(বাঁ দিক থেকে) কুণাল ঘোষ, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস রায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

কথায় বলে, ‘শতং বদ, মা লিখ’। অর্থাৎ, মুখে ১০০ কথা বলতে পারো, কিন্তু খবরদার কিছু লিখতে যেও না! তবে গত কয়েক দিনে রাজ্য-রাজনীতিতে যা ঘটল, তাতে হয়তো বলা হবে, ‘মা বদ, মা লিখ।’ অর্থাৎ, কোনও কথা বলতে যেও না। লেখা তো দূরস্থান!

Advertisement

নীরবতা যে সত্যিই হিরন্ময়, সেটা দেখালেন তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনীতিতে বাগ্মিতার মাহাত্ম্য রয়েছে। কিন্তু কখনও কখনও নীরবতাও প্রয়োজন। গত কয়েক দিনে বঙ্গ রাজনীতি দেখল, যে সয় সে রয়। দেখল, নীরব থাকলে কী ফল হয়। আর কথা বললেই বা কী হতে পারে!

কথা বলে দিনের শেষে দলই ছেড়ে দিতে হল প্রবীণ রাজনীতিক তথা তৃণমূলের বিধায়ক তাপস রায়কে। আর কুণাল ঘোষ পেলেন শো-কজ়ের নোটিস! ‘নৈতিকতা’ দেখিয়ে তাপস দল ছাড়ার পাশাপাশি তাঁর বিধায়কের পদেও ইস্তফা দিয়েছেন। আর কুণাল গিয়েছেন সুদীপের আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে চা পান করতে। যে সুদীপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলায় তাঁকে তার কারণ দর্শাতে বলেছে দল। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল সেই মুখপাত্রের পদ এবং দলের রাজ্য সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা পেশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। মুখপাত্রের পদ থেকে কুণালের ইস্তফা ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, ‘মা বদ’। দল তাঁর মুখে লাগাম পরিয়ে দিয়েছে।

দলের অন্দরে কুণালের তথাকথিত বিরোধীরা বলছেন, সুদীপ সম্পর্কে কুণাল যা বলেছেন, তাতে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হতে পারেন অভিষেক। কারণ, তৃণমূলের সেনাপতির দলের অন্দরে লড়াই নবীন-প্রবীণ প্রশ্নে। সেটি তাঁর একটি নৈতিক অবস্থান। ভাল বা খারাপ— যেমনই হোক। কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের নিরিখে নয়। কিন্তু কুণাল সুদীপকে ‘ব্যক্তি আক্রমণ’ করেছেন। এক নয়, একাধিক বার। তার সঙ্গে নীতির কোনও সংশ্রব নেই বলেই দলের অন্দরে কুণালের সমালোচকেরা মনে করছেন।

বস্তুত, তৃণমূলের অন্দরে কুণালকে অনেকে আড়ালে ‘সুব্রহ্মণ্যম স্বামী’ বলে বর্ণনা করতে শুরু করেছেন। যাঁকে বিজেপি রাজ্যসভায় টিকিট দিয়ে সাংসদ করার পরে তিনিই বিজেপির অন্যতম বড় সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কুণাল নিজেও কি তা-ই মনে করেন? প্রাক্তন মুখপাত্রের জবাব, ‘‘আমি তো পার্টির ক্ষতি করার জন্য কিছু বলিনি বা করিনি। পার্টি একটা পরিবার। নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেতার নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি সেই তৃণমূল পরিবারের সৈনিক।’’

তাপস-কুণালেরা গত কয়েক দিন ধরে যাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক বোমা ফাটিয়েছেন, বিবিধ শব্দবন্ধে বিদ্ধ করেছেন, তখন একেবারে নীরব থেকেছেন সেই সুদীপ। এমনকি, সংবাদমাধ্যমের কোনও প্রশ্নেরও জবাব দেননি। পাল্টা বক্তব্য পেশ করে বিতর্কে নতুন রসদ যোগাতে পারতেন। কিন্তু সে পথে হাঁটেননি লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা। অবশেষে সোমবার সকালে কুণালের কাছে দলের শো-কজ়ের চিঠি পৌঁছনোর পরে সুদীপ ফোন করে সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কুণালকে। সুদীপের বাড়িতে ব্রিগেডের প্রস্তুতি বৈঠকে কুণালকে আমন্ত্রণ না-জানানো নিয়ে গোলমালের সূত্রপাত হয়েছিল। কুণালের দাবি, সুদীপ তাঁকে ফোন করে বলেছেন, চিঠি পৌঁছয়নি। সেই কারণেই যাবতীয় সমস্যা। কিন্তু বাইরে সুদীপ কিছু বলেননি। এত কিছুর পরেও বলেননি। কু‌ণাল পৌঁছনোর আগে সুদীপ একটি কর্মসূচি থেকে বাড়িতে ঢুকেছিলেন। তখনও যাবতীয় প্রশ্নের জবাবে সুদীপ বলেন, ‘‘নো কমেন্টস।’’

এর আগে তৃণমূলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ বিতর্কে গত ১ জানুয়ারি তোলপাড় হয়েছিল তৃণমূলে। তখনও তাপস-কুণাল সরব হয়েছিলেন। তখনও তাঁদের লক্ষ্য ছিলেন সুদীপই। কিন্তু তখনও সুদীপ মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। ভোটের মুখেও সুদীপ সম্পর্কে সেই কুণাল-তাপস জুটিই ময়দানে নেমেছিলেন। তার মধ্যে তাপসকে দল ছাড়তে হয়েছে। আর যে সুদীপ সম্পর্কে প্রকাশ্যে ‘বিজেপির লোক’ বলে আক্রমণ শানিয়েছিলেন কুণাল, তাঁরই আমন্ত্রণে এবং তাঁরই বাড়িতে চা পান করতে যেতে হয়েছে তাঁকে।

তৃণমূলের অন্দরমহল বলছে, পুরো সময়কালে সুদীপ একেবারে নীরব থেকে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। কারণ, ওই বাগ্‌বিতণ্ডায় তাঁর উত্তর কলকাতার টিকিটটি আরও ‘নিশ্চিত’ হয়ে গেল বলেই দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী মনে করছেন।

বঙ্গ রাজনীতিতে নীরব থেকে ‘সুফল’ পাওয়া রাজনীতিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ভরা বাম জমানায় উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্যকে ‘চরবৃত্তি’র অভিযোগে বহিষ্কার করেছিল সিপিএম। সেই নেপালদেব কয়েক বছর চুপ করে থেকে ধারাবাহিক ভাবে দলের কর্মসূচিতে যোগ দিতেন, গণ সংগঠনের কাজ করতেন, বানিয়েছিলেন সিনেমাও। পরে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নিয়েছিল সিপিএম। এমনকি, রাজ্য কমিটিরও সদস্য হয়েছিলেন তিনি। আবার কথা বলে শাস্তি পাওয়ার নজিরও রয়েছে। তদন্ত কমিশন চলাকালীন সাংবাদিক বৈঠক করে বিমান বসুর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন আরামবাগের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ অধুনাপ্রয়াত অনিল বসু। কালক্ষেপ না করে সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। কিন্তু তিনি আর দলে ফিরতে পারেননি।

এমনিতে অবামপন্থী দলে নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য আকচাআকচি লেগে থাকে। যদিও এ ক্ষেত্রে বিজেপি ব্যতিক্রম। তারা দক্ষিণপন্থী দল হলেও পার্টি শৃঙ্খলাবদ্ধ। সেখানে বেশ ‘উদার’ পরিবেশ নেই। কংগ্রেসের ক্ষেত্রেও রাজ্যে-রাজ্যে নেতাদের লড়াই, এক নেতার বিরুদ্ধে অন্য নেতার ক্ষোভ দেখিয়ে দল ছেড়ে যাওয়া নতুন নয়। অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে, পঞ্জাবে ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ— এমন উদাহরণ অনেক। ভোটের আগে সুদীপ দেখালেন, বঙ্গ রাজনীতিতে কথা না বলার উপকারিতা রয়েছে। ভোটের আগে তা আরও বেশি কাজে লাগে। ‘মা বদ’!

আরও পড়ুন
Advertisement