গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
সন্দেশখালি ৫০ দিনেরও বেশি ধরে অশান্ত। নিয়মিত সেখানে যাচ্ছেন শাসক থেকে বিরোধী দলের নেতৃত্ব। গিয়ে শুনছেন গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কথা প্রকাশ পাচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। তবে স্থানীয় আদি তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ গোটা পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন জেলবন্দি তৃণমূল নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালুকে। তাঁদের দাবি, বালুর প্রশ্রয়েই নাকি বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল শাহজাহান শেখের মতো নেতাদের। তবে দলের অন্য একটি অংশ বলছে, বালুর জেলে থাকার সুযোগ নিয়ে তাঁর ঘাড়েই যাবতীয় দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিল বলেই সব দায় বালুর উপর চাপাতে হবে, এমনটা হলে ভুল হবে। কারণ দল তো আর বালুর একার কথায় চলত না! যে একার জোরেই তিনি শাহজাহান-বাবুদের প্রশ্রয় দেবেন!
জ্যোতিপ্রিয়ের জন্ম অবিভক্ত বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বরে হলেও, তাঁর কর্মভূমি কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যুব কংগ্রেস করার সময় থেকেই নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হিসাবেই পরিচিত বালু। ১৯৯৮ সালে দল গঠনের সময় থেকেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাজনীতিতে তাঁকে সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন মমতা। এক সময় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাজনীতিতে বালুই হয়ে উঠেছিলেন ‘শেষ কথা’। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর তাঁর সাংগঠনিক প্রভাব খানিকটা কমলেও, জেলায় তাঁর যোগাযোগ ছিল অটুট। ১০ বছর গাইঘাটা এবং পরে তিন বার হাবড়া থেকে বিধায়ক হয়ে উত্তর ২৪ পরগনার জেলার মাটিকে তিনি চিনতেন অনেকটাই হাতের তালুর মতো। কখনও জেলা সংগঠনের পর্যবেক্ষক তো কখনও জেলার সভাপতি হিসেবেই দাপট ছিল তাঁর।
২০১১ সালের রাজ্যে বামফ্রন্টকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। রাজ্য মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে ‘পরিবর্তন’ শুরু হয় জ্যোতিপ্রিয়ের। বনগাঁ-বসিরহাটের মতো সীমান্তবর্তী এলাকায় সিপিএমের হাতে থাকা ‘হার্মাদবাহিনী’র (পরিবর্তনের আগে সিপিএমের সশস্ত্র ভোট ম্যানেজারদের এই নামেই ডাকত তৃণমূল) সদস্যদের একে একে দলে যোগদান করান তিনি। সেই পর্যায়েই ২০১৩ সালে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে নাম লেখান শাহজাহান, বাবু মাস্টারের মতো ‘বাহুবলী’রা। বালুর হাত ধরেই তাদের তৃণমূলে আগমন। তৃণমূলের আদি নেতারা সেই সময় অনেকেই দলে এই সব নেতাদের যোগদানের বিরোধিতা করলেও, তাতে কর্ণপাত করেননি জ্যোতিপ্রিয়। জেলায় বালুর নেতৃত্বে এমন সব ‘কুখ্যাত’ নেতাদের যোগদান এক সময় রেওয়াজ হয়ে ওঠে বলেই জানাচ্ছেন বসিরহাট এলাকার তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতা। ট্রেকারের হেলপার থেকে রাতারাতি শাহজাহান তাঁর ‘তাজমহল’ তৈরি করেন সন্দেশখালির মাটিতে। হয়ে ওঠেন কয়েকশো কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। কোন জাদুদণ্ডে তাঁর এমন প্রতিপত্তি, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা ছিল না সন্দেশখালির বাসিন্দাদের। সবাই শুধু জানতেন, পুলিশ-প্রশাসন নয়, বিচার দিতে পারেন একমাত্র শাহজাহান। তাঁর কথাই সন্দেশখালির জনতার কাছে ‘ঈশ্বরের বাণী’।
সদ্যসমাপ্ত বাজেট অধিবেশনের সময় সন্দেশখালি এলাকার এক পঞ্চায়েত সদস্য তথা বসিরহাটের আদি নেতা জেলার প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে বিধানসভায় এসেছিলেন। সেখানেই ওই পঞ্চায়েত সদস্য সন্দেশখালির ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী করেন জ্যোতিপ্রিয়কে। বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষের কাছে অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, ‘‘২০১১ সালের আগে আপনি আর বালুদা এক বার সন্দেশখালি গিয়েছিলেন। সেই সময় আপনাদের বোমাবাজি করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেছিল এই শাহজাহান ও তাঁর বাহিনী। তাঁদেরই জামাই আদর করে দলে এনে ক্ষমতা দেওয়া হল। আমাদের কথা শোনা হল না, এখন যা হচ্ছে, তা সেই কর্মের ফল।’’ সাধারণ মানুষের জমি কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে রাতে পার্টি অফিসে বাড়ির মেয়ে-বৌদের ডেকে আনাও যে তাঁদের মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হয়েছে, তা-ও দ্বিধাহীন ভাবে রাজ্যের কয়েক জন মন্ত্রীকে জানিয়েছেন ওই আদি তৃণমূলের নেতা। রাজ্যের এক প্রবীণ মন্ত্রীও তাঁর সঙ্গে একমত হন যে, শাহজাহানের মতো ‘অসামাজিক’ নেতাকে তৃণমূলে যোগদান করানো বালুর ভুল হয়েছিল!
বালুর প্রশ্রয় পেয়েই শাহজাহান সন্দেশখালির ‘সম্রাট’ হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, শাহজাহানকে ধরেই একে একে উঠে এসেছিলেন নানা অপরাধমূলক কাজে হাত পাকানো শিবু-উত্তম-সিরাজেরা। এদের সকলেরই তৃণমূলে আগমন ২০১১ সালের পরে, বালুর হাত ধরেই। এর পর শুধুই ক্ষমতার জোরে শাহজাহানদের ক্ষমতার বৃদ্ধির পারদ ও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে উল্কার গতিতে। এমনটাই অভিযোগ তৃণমূলের আদি নেতাদের একাংশের।
একই কায়দায় হাসনাবাদে বাবু মাস্টারকেও দলে এনেছিলেন বালু। তবে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বাবু যোগ দেন বিজেপিতে। ভোটে বিজেপির পরাজয় হলে বালুর হাত ধরে বাধ্য ছেলের মতোই ফিরে আসেন তৃণমূলে। বসিরহাট এলাকার এক প্রবীণ সংখ্যালঘু তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘বালুদা আমাদের কথা শুনতেই চাইতেন না। তাঁর কাছে শাহজাহান, সিরাজেরাই আপন হয়ে উঠেছিল। এলাকায় দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে এদের দলে এনে ক্ষমতা দিয়েছিলেন বালুদাই। এ কথা বসিরহাটে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা সবাই জানেন। কিন্তু এখন আর বলে কি লাভ! বালুদা এখন জেলে বসে আছেন, যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে।’’
২০১৯ সালের জুন মাসে বসিরহাটে একই দিনে তিন জন বিজেপি কর্মী খুন হন। সেই ঘটনায় অভিযোগের আঙুল ওঠে শাহজাহানের দিকে। রাজ্য পুলিশের এক বড় কর্তার নির্দেশে সন্দেশখালি থানার পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। কিন্তু বালুর প্রচেষ্টাতেই থানায় নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল শাহজাহানকে। এমন হাজারো ‘প্রশ্রয়ের কাহিনি’ এখন শোনা যাচ্ছে বসিরহাটের শাসকদলের অন্দরমহলে। সাম্প্রতিক অতীতে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলামের মতো আদি নেতাদের বসিরহাট জেলা সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁদের এড়িয়ে শাহজাহান-বাবুদের দাপটের উপরেই ভরসা রেখে সংগঠনের কাজকর্ম করতেন বালু, এমনটাই অভিযোগ। এমনকি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পাত্তা না দেওয়ার ‘সংস্কৃতি’ও বালুর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন শাহজাহান ও তাঁর নিজস্ব বাহিনী। এমনই সব অভিযোগ তুলে জ্যোতিপ্রিয়কে দুষছেন দলের আদি নেতাদের একাংশ।