শাহজাহান শেখ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কলকাতা হাই কোর্ট সোমবার জানিয়ে দিয়েছে, শাহজাহান শেখকে গ্রেফতারের ব্যাপারে রাজ্য পুলিশের উপর কোনও বিধিনিষেধ নেই। তার পরেই সোমবার তৃণমূলের ওই নেতার বিরুদ্ধে নতুন করে সন্দেশখালি থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। যদিও ন্যাজাট থানায় এর আগে শাহজাহানের বিরুদ্ধে একাধিক এফআইআর দায়ের করা হয়। কখনও খুনের অভিযোগ, তো কখনও সরকারি কর্মীকে হেনস্থা বা মারধর করার অভিযোগ।
ন্যাজাট থানায় শাহজাহানের বিরুদ্ধে একটি খুনের মামলা দায়ের হয়েছিল ২০১৯ সালের ৮ জুনের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। লোকসভা নির্বাচনের পর পরই ঘটেছিল সেই ঘটনা। শাহজাহান, ফিরোজ কামাল গাজি-সহ মোট ২৫ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়। দেবদাস মণ্ডল-সহ কয়েক জনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছিল। কী ঘটেছিল সে দিন? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শাহজাহান, ফিরোজের নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ জনের একটি দল দেবদাসের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়ে। তাঁদের হাতে ছিল অস্ত্র। বাড়িতে আগুন দেয় শাহজাহানের নেতৃত্বাধীন সেই বাহিনী। দেবদাস পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে ধরে ফেলা হয়। অভিযোগ, কয়েক জন দেবদাসকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায়। তার পর খোঁজ মেলেনি দেবদাসের।
ওই দিনের ঘটনায় নিহত হন দেবদাসের বাবা প্রদীপ মণ্ডল। অভিযোগ ছিল, দেবদাস এবং তাঁর বাবা বিজেপিকে সমর্থন করেন। প্রদীপের মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয় বলেও অভিযোগ। মারা যান প্রদীপ। স্থানীয়দের একাংশ অভিযোগ করেন, ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয় দেবদাসকে। বিজেপির সুকান্ত মণ্ডল এবং তৃণমূলের কায়ুম মোল্লাও নিহত হন ওই ঘটনা। এর পরেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সন্দেশখালি। পরে দেবদাসের দেহ মেলে। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেবদাস এবং প্রদীপের দেহ শনাক্ত করা হয়েছিল। তাঁদের খুনের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার পর ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ৪৪৮, ৩২৫, ৩২৬, ৩০২, ৩৭৯, ৪২৭ ধারায় মামলা দায়ের হয়। অস্ত্র আইন, তফশিলি জাতি, জনজাতি প্রতিরক্ষা আইনেও মামলা হয়।
২০২২ সালের ২৫ জুন শাহজাহানের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২২ সালে শাহজাহানের নির্দেশে ডব্লিউবিএসইডিসিএল (রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন পর্ষদ)-এর সরবেড়িয়ার কাস্টমার সেন্টারে স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে পড়েন কয়েক জন। তার পর তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। চার কর্মীকে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে মারধরও করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন খোদ শাহজাহান। বেআইনি ভাবে জমায়েত, আঘাত, চুরি, বেআইনি ভাবে প্রবেশ, সরকারি কর্মীকে মারধরের অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯ ১৮৬, ৪৪৭, ৩৫৩, ৩৩২, ৩৩৩, ৩২৬, ৩০৭, ৪২৭, ৫০৬ ধারায় মামলা দায়ের হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দিনই সরবেড়িয়া মোড়ে বাসন্তী হাইওয়ে অবরোধ করেন প্রায় ৭০০ জন। নেতৃত্ব ছিলেন শাহজাহান। তাঁদের অভিযোগ ছিল, বিদ্যুতের বিল বেশি আসছে। এই অবরোধের কারণে অ্যাম্বুল্যান্স-সহ বিভিন্ন যানবাহন আটকে পড়ে। অবরোধকারীরা পাথর ছোড়ে। পুলিশকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। এর ফলে ন্যাজাট থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। জাতীয় সড়ক আইন, পশ্চিমবঙ্গ সড়ক আইন, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর প্রতিরোধ আইনে। এই অভিযোগগুলি ইডি আদালতে জমা করেছে আগেই।
নতুন এফআইআরে শাহজাহানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তিনি ৮০ হাজার টাকা লুট করেছেন বলে দাবি অভিযোগকারীর। এ ছাড়া, ঘরবাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগও রয়েছে শাহজাহানের বিরুদ্ধে। পুলিশ সূত্রে খবর, গৌর দাস নামের এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে এই এফআইআর হয়েছে। ওই অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বসিরহাট জেলা পুলিশ।
সোমবারই কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে পারবে রাজ্য পুলিশ। তাতে কোনও বাধা নেই। আদালত তেমন কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি। তৃণমূলের তরফে বলা হচ্ছিল, আদালতের নির্দেশের কারণেই শাহজাহানকে রাজ্য পুলিশ গ্রেফতার করতে পারছে না। শাসকদলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গত বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে রাজ্য সরকার। ইডি তাঁকে ধরতে পারেনি। কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গিয়ে রাজ্য পুলিশের ওই এফআইআরের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পেয়েছে। ফলে পুলিশের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে আদালতই।’’ সোমবার হাই কোর্টে সেই প্রসঙ্গে উঠলে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম স্পষ্ট করে জানান, ইডির মামলায় সিট গঠনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। শাহজাহানকে গ্রেফতার করার বিষয়ে কোনও স্থগিতাদেশ আদালত দেয়নি।