প্রসন্ন রায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
তৃণমূলের লোকজনও তাঁকে চিনতেন ‘রাজেশ’ নামে। গ্রেফতার হওয়ার পর জানতে পারেন, নাম আসলে প্রসন্ন। প্রসন্ন রায়। নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করতে নেমে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করার কিছু দিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি গ্রেফতার করে ‘মিডলম্যান’ প্রসন্নকে। পার্থ এবং প্রসন্নের মধ্যে যোগসূত্র মিলেছে বলেই ইডি সূত্রে খবর। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী তথা বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক পার্থের দফতরে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল বলেও ‘প্রমাণ’ মিলেছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রসন্নকে পার্থ-ঘনিষ্ঠেরাও প্রায় সবাই চিনতেন ‘রাজেশ’ নামেই।
বেহালা পশ্চিমের এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘পার্থদা মন্ত্রী ছিলেন বলে অনেকেই বেহালার পার্টি অফিসে আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাদের সকলের পরিচয় জানার অধিকার সবার ছিল না। কে, কেন পার্থদার কাছে আসতেন তা একমাত্র জানত ভজা (১২৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পার্থ সরকার)।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই প্রসন্নকে আমরা প্রথম পার্থদার অফিসেই দেখি। তাঁকে আমরা চিনতাম রাজেশ নামে। রাজেশ এলেই আমাদের সকলকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত বৈঠক। সেই বৈঠকে ভজা ছাড়া আর কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। রাজেশ গ্রেফতার হওয়ার পর আমরা জানতে পারলাম ওঁর নাম আসলে প্রসন্ন রায়।’’
২০০১ সালে বেহালার সিপিএম নেতা নির্মল মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে প্রথম বার বিধায়ক হন পার্থ। তার পরেই বেহালা ম্যান্টনে নিজের বিধায়ক কার্যালয় তৈরি করেন তিনি। সেই থেকে গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে এই কার্যালয়েই বসতেন পার্থ। বেহালার তৃণমূল নেতৃত্ব সূত্রে খবর, ২০১৩ সালের পার্থ যখন শিক্ষা দফতরের দায়িত্ব পান, তখন থেকেই প্রসন্ন ওরফে রাজেশের বেহালার ম্যান্টনের সেই পার্টি অফিসে যাতায়াত শুরু হয়। ২০১৬ সালে পার্থ বেহালা পশ্চিম থেকে চতুর্থবার বিধায়ক হলে, তাঁকে শিক্ষা দফতরেই রেখে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর বেহালার পার্টি অফিসে ঘনঘন যাতায়াত শুরু করেন প্রসন্ন ওরফে রাজেশ।
প্রসন্ন ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর বেহালায় পার্থ-ঘনিষ্ঠেরা তা দেখে চমকে যান। তাঁরা জানতে পারেন, রাজেশ হচ্ছে নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রসন্ন রায়। এমনটা জানলেও বেহালার তৃণমূলের কোনও নেতা সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। বেহালার এক আইনজীবী নেতার কথায়, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দল সাসপেন্ড করেছে। তাই এখন তাঁর সঙ্গে দলের কোনও যোগাযোগ নেই। তাই আমরা সেই বিষয়ে কিছু বলব না। এটা ঠিক যে ওই প্রসন্ন রায় রাজেশ নাম নিয়ে পার্থদার অফিসে প্রায়ই আসত।’’
পার্থ-ঘনিষ্ঠ ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পার্থ সরকার (ভজা)-কে নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে জেরা করতে চায় ইডি। সেই কারণে সম্প্রতি তাঁকে আবারও তলব করা হয়েছে। যদিও, এর আগে দু’বার ইডির তলব এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু পার্থ-রাজেশের বহু বৈঠকে যে ভজা উপস্থিত থাকত, তা জোর দিয়ে বলছেন একদা পার্থ ঘনিষ্ঠরাই। তাঁদের কথায়, ‘‘ভজাদাকে ইডি জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক কিছুই জানতে পারবে। কারণ পার্থদা ছাড়াও রাজেশদা ভজার সঙ্গেও একান্তে বহু সময় কাটিয়েছেন বেহালার অফিসে, তার সাক্ষী রয়েছেন অনেকেই। কারণ সেই সময় ভজা দুর্ব্যবহার করে তৃণমূল কর্মীদের পার্টি অফিসের বাইরে বের করে দিত।’’
ভজাকে ইডি ফের তলব করা নিয়ে মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাই বেহালা পশ্চিমের তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ মনে করছে, দল সেভাবে কাউন্সিলর ভজার পাশে নেই। প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে পার্থ বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক হলে, তাঁর হাত ধরেই বেহালা রাজনীতিতে আগমন ভজার। সেই থেকে বেহালার রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠেন ভজা। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার পার্থের কাছে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাননি তৃণমূল কর্মীরা। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বাদ দিয়ে অন্য ওয়ার্ড থেকে তুলে এনে ভজাকে ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করেন পার্থই। আর সেই ভোটে ব্যাপক রিগিং করে তাঁকে হারানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন বিদায়ী পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী সিপিএম নেত্রী রত্না রায় মজুমদার। সেই সময়েও পার্থের অফিসে এসে ভজাকে জয়ী হওয়ার জন্য আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন এই প্রসন্ন ওরফে রাজেশ।