Bengal SSC Recruitment Case

‘এ ছাড়া উপায় ছিল না’! যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে ২৫,৭৫৩ চাকরি বাতিলের রায় দিয়ে বলল হাই কোর্ট

কলকাতা হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হবে বলে সোমবারই জানিয়েছেন এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। এসএসসি নিয়োগ মামলায় রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েছে তৃণমূল।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৫৭
Graphical Representation

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

লোকসভা ভোটপর্বের মধ্যেই ঘোষিত হল রাজ্যে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলা মামলা ‘নিয়োগ দুর্নীতি’র রায়। সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালের এসএসসির সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়েছে। ২৮২ পাতার এই রায়ের ফলে শিক্ষক পদের পাশাপাশি গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি মিলিয়ে বাতিল হয়েছে মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি। রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারপতি বসাকের মন্তব্য, ‘‘এ ছাড়া (চাকরি বাতিল করা) কোনও উপায় ছিল না।’’

Advertisement

কলকাতা হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হবে বলে সোমবারই জানিয়েছেন এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এসএসসি নিয়োগ মামলার রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েছে। কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে যে শিক্ষকেরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার রায়গঞ্জের জনসভা থেকে জানান, আদালতের সোমবারের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন তিনি। এই রায়কে ‘বেআইনি’ বলেও দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ‘অতিরিক্ত শূন্যপদ’ (সুপার নিউমেরিক পোস্ট) সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের গ্রেফতার করে জেরার দাবি তুলেছেন।

দুই বিচারপতির বেঞ্চ সোমবার জানিয়েছে, এসএসসি প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে হবে। সুদের হার হবে বছরে ১২ শতাংশ। চার সপ্তাহের মধ্যে বেতন ফেরত দিতে বলেছে আদালত। এসএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনেক ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে আপলোড করা হয়েছে। যেগুলি এখনও আপলোড করা হয়নি, সেগুলি দ্রুত আপলোড করার নির্দেশও দিয়েছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। জানিয়েছে, উত্তরপত্র জনগণ যাতে দেখতে পান, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে কমিশনকে।

একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে, এই মামলার তদন্ত চালিয়ে যাবে সিবিআই। অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির জন্য চাইলে সন্দেহভাজনদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে কেন্দ্রীয় সংস্থা। সকলের চাকরি বাতিল করা হলেও এক জনের চাকরি থাকছে। সোমা দাস নামের এক চাকরিপ্রাপক ক্যানসারে আক্রান্ত। মানবিক কারণে তাঁর চাকরি বাতিল করেনি বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ।

প্রসঙ্গত, গত তিন বছরে বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা বিষয় নিয়োগ ‘দুর্নীতি’ মামলা। স্কুলে শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে বহু অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। টেট (প্রাথমিক স্কুল) এবং এসএসসি-র (মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক) দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে অভিযোগ। টেট মামলা আপাতত সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। সোমবার এসএসসির চাকরি বাতিলের মামলার রায় ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। ২৮২ পাতার রায় আদালতে পড়ে শোনান বিচারপতি বসাক।

এই মামলায় প্রথমে হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চেও সেই নির্দেশ বহাল থাকে। এর পর মামলা গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেখান থেকে মামলাগুলি হাই কোর্টে আবার ফেরত পাঠানো হয়। মে মাসের মধ্যে হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চকে শুনানি শেষ করে রায় ঘোষণা করতে বলেছিল শীর্ষ আদালত। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে শুনানি শেষ হয়ে গিয়েছে। সোমবার রায় ঘোষণা করল দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।

হাই কোর্টের রায় কী কী জানাল?

২৮২ পাতার রায়ে মূলত ছ’টি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।

প্রথমত, ২০১৬ সালে এসএসসিতে শিক্ষক, গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল হবে। অর্থাৎ, ২৫ হাজার ৭৫৩ জন চাকরি হারাবেন।

দ্বিতীয়ত, নতুন নিয়োগ কী ভাবে হবে তা-ও জানিয়েছে হাই কোর্ট। নির্দেশ দিয়েছে, এসএসসির ঘোষিত শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এসএসসি নতুন করে ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে নিয়োগ শুরু করতে পারবে। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে তারা ওই পুনর্মূল্যায়নের কাজ শুরু করতে পারবে। ‘ওপেন টেন্ডার’-এর মাধ্যমে ওই বরাত দিতে পারবে এসএসসি।

তৃতীয়ত, হাই কোর্ট জানিয়েছে, এসএসসির প্যানেলের বাইরে, মেয়াদ শেষের পরে এবং যাঁরা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সকলকেই জনগণের টাকা থেকে বেতন দেওয়া হয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে সুদ-সহ সেই বেতন ফেরত দিতে হবে এই তিন শ্রেণির বেআইনি ভাবে চাকরি প্রাপকদের। বছরে ১২ শতাংশ হারে সুদসমেত টাকা ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা টাকা ফেরত না দিলে কী করা হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছে দু’বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসককে ছ’সপ্তাহের মধ্যে বেতনের টাকা সুদ-সহ আদায় করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। জেলা স্কুল পরিদর্শকেরা জেলাশাসককে জানাবেন ওই ব্যক্তি কত টাকা বেতন নিয়েছেন।

চতুর্থত, এসএসসিতে বেআইনি নিয়োগ করতে অনেক ‘অতিরিক্ত শূন্যপদ’ (সুপারনিউমেরিক পোস্ট) তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকারই সেই অনুমোদন দিয়েছিল। সোমবার কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়েছে, সিবিআই রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত সেই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করবে, যাঁরা অতিরিক্ত পদ তৈরির অনুমোদন দিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রয়োজনে ওই ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে কেন্দ্রীয় সংস্থা, জানিয়েছে আদালত।

পঞ্চমত, এসএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনেক ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে আপলোড করা হয়েছে। যেগুলি এখনও আপলোড করা হয়নি, সেগুলি দ্রুত আপলোড করার নির্দেশও দিয়েছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। জানিয়েছে, উত্তরপত্র জনগণ যাতে দেখতে পান, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে এসএসসি কর্তৃপক্ষকে।

ষষ্ঠত, এসএসসিতে আইন ভেঙে নিয়োগ সংক্রান্ত চারটি মামলায় সিবিআই তদন্ত চালিয়ে যেতে পারবে বলে জানিয়েছে হাই কোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, প্যানেলের মেয়াদ শেষের পরে, সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে সিবিআই। প্রয়োজনে তাঁদের হেফাজতেও নিতে পারবে সিবিআই। তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে সিবিআইকে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ।

Graphical Representation

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কেন পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করল হাই কোর্ট?

দুই বিচারপতি ডিভিশন বেঞ্চ চাকরি বাতিলের ‘কারণ’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূলত তিনটি বিকল্পের উল্লেখ করছেন। বিচারপতি বসাক রায় পড়ে শোনাতে গিয়ে জানান, তাঁদের সামনে মোট তিনটি পথ খোলা ছিল— প্রথমত, গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে মূল মামলাগুলি খারিজ করা। অর্থাৎ যে নিয়োগগুলি হয়েছে, তা বহাল রাখা। দ্বিতীয়ত, বেআইনি নিয়োগ থেকে যোগ্যদের আলাদা করা। তৃতীয়ত, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা।

এর পর প্রথম ‘পথ’ অনুসরণ না-করার কারণ জানিয়ে বিচারপতি বসাক বলেন, ‘‘মূল মামলাগুলির গ্রহণযোগ্যতা আদালতের কাছে রয়েছে।’’ দ্বিতীয় বিকল্প বেছে না-নেওয়ার ‘কারণ’ জানাতে গিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘নানা দিক থেকে দুর্নীতি করা হয়েছে। ফলে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে যোগ্যদের আলাদা করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির গতিমুখ একটি নির্দিষ্ট দিকে থাকলে যোগ্যদের আলাদা করে নির্ণয় করা সহজ হত।’’ তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ, এসএসসির শিক্ষক, গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ ডি নিয়োগের পুরো প্যানেল (যার মাধ্যমে ২৫ হাজার ৭৫৩ জন চাকরি পেয়েছিলেন) বাতিল করার সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে ১৭টি পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে দিয়েছে বেঞ্চ। জানিয়েছে, এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও উপায় ছিল না।

১৭ দফায় কী ভাবে হয়েছিল দুর্নীতি? কী বলল হাই কোর্ট

বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ রায়ের যুক্তি হিসাবে ১৭ দফার পর্যবেক্ষণের উল্লেখ করেছে। জানিয়েছে, ওই ১৭টি পথেই হয়েছিল এসএসসিতে নিয়োগ দুর্নীতি। সেগুলি হল—

১) ওএমআর শিট স্ক্যান এবং মূল্যায়নের জন্য ‘নাইসা’ নামের একটি সংস্থাকে এসএসসি বরাত দিয়েছিল। তাদের টেন্ডার দেওয়া হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন পদক্ষেপ সংবিধানের ১৪ ও ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে।

২) নাইসা আবার অন্য একটি সংস্থাকে এই স্ক্যানের কাজ করতে দেয়।

৩) এসএসসি দফতরে ওএমআর শিট স্ক্যান করে ওই সংস্থা। অথচ এসএসসি ওই সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়নি। ফলে টেন্ডার করার পরেও বিষয়টি বেআইনি থেকে যায়।

৪) ওএমআর শিটের আসল কপি এসএসসি নষ্ট করে দেয়। সে ক্ষেত্রে ওএমআর শিটের ‘মিরর ইমেজ’ এসএসসির সার্ভারে সংরক্ষিত থাকার কথা।

৫) সিবিআই কিন্তু এসএসসির সার্ভার থেকে ওই ধরনের কোনও ‘মিরর ইমেজ’ খুঁজে পায়নি।

৬) সিবিআইয়ের দাবি, ওএমআর শিট স্ক্যান করে তার মিরর ইমেজ সংরক্ষণ না করেই আসল কপি নষ্ট করেছে এসএসসি।

৭) এসএসসি আবার তথ্য জানার অধিকার আইনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আবেদনকারীদের স্ক্যান ওএমআর শিট দেখায়। এসএসসি জানায়, তাদের ডেটাবেস থেকেই ওগুলি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিবিআই এসএসসির সার্ভার থেকে কিছুই পায়নি।

৮) গ্রপ ডি, গ্রুপ সি, নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ— ওই চার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘোষিত শূন্যপদের থেকে বেশি প্রার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছে।

৯) প্যানেলে নাম নেই এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়েছে।

১০) সাদা খাতা জমা দিয়ে অনেকে চাকরি পেয়েছেন।

১১) প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও চাকরি দেওয়া হয়েছে।

১২) কম নম্বর থাকা সত্ত্বেও চাকরি দেওয়া হয়েছে।

১৩) মেধাতালিকায় প্রার্থীদের নম্বর প্রকাশ করা হয়নি।

১৪) প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কাউন্সেলিং চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

১৫) বেআইনি ভাবে কত জন চাকরি পেয়েছেন তা নিয়ে অস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং রাজ্যের।

১৬) বেআইনি নিয়োগ আড়াল করতে সুপারনিউমেরিক পোস্ট তৈরি করে নিয়োগের জন্য এসএসসি আবেদন করে।

১৭) ওই চারটি বিভাগের কোনও ক্ষেত্রেই নিয়োগ পদ্ধতির কোনও রকমের নিয়ম মানা হয়নি।

Graphical Representation

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সুপারনিউমেরিক পোস্ট কী? কোন সময়ে তৈরি?

এসএসসির মাধ্যমে নিয়োগে অনিয়মের মামলায় অন্যতম অভিযোগ ছিল, টাকার বিনিময়ে যাঁরা বেআইনি ভাবে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত শূন্যপদ ছিল না। তাই বেশ কিছু অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরি করা হয়েছিল। এগুলিকেই সুপারনিউমেরিক পদ বলা হচ্ছে। ওই পদগুলিতেই অযোগ্য প্রার্থীদের একটা বড় অংশকে নিয়োগ করা হয় বলে অভিযোগ। এ ভাবেই খাতায়-কলমে দেখানো হয়, তাঁদের নিয়োগ আসলে বৈধ। আদালত জানিয়েছে, এই অতিরিক্ত পদ তৈরি করে অবৈধ নিয়োগগুলিকে স্বীকৃতি দিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভাতেও সেই সিদ্ধান্তগুলির অনুমোদন হয়েছে।

এসএসসি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে স্কুল শিক্ষা দফতরের একটি চিঠি হাতে পেয়েছে সিবিআই। যা তারা আদালতে জমা দিয়েছে। সেখানে চিঠির বিষয় হিসাবে বলা হয়েছে, ‘‘ওয়েটিং লিস্টের চাকরিপ্রার্থীদের জন্য বিভিন্ন সরকারি এবং সরকার-পোষিত স্কুলে সহকারী শিক্ষক (কর্মশিক্ষা, শারীরশিক্ষা-সহ) এবং অশিক্ষক কর্মীর কিছু ‘সুপারনিউমেরিক পোস্ট’ তৈরির প্রস্তাব।’’ রাজ্য মন্ত্রিসভাকে ওই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

প্রস্তাবপত্রে নবম-দশমের জন্য ১,৯৩২টি, একাদশ-দ্বাদশের জন্য ২৪৭টি শিক্ষকের অতিরিক্ত পদ তৈরির কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া, গ্রুপ সি-র ১,১০২টি, গ্রুপ ডি-র ১,৯৮০টি অতিরিক্ত পদ এবং শারীরশিক্ষা, কর্মশিক্ষায় মোট ১,৬০০টি অতিরিক্ত পদ তৈরির কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, সিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসা এই নথিতে ২০২২ সালের ৫ মে তারিখ দেওয়া রয়েছে। ২০২১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরেই শিক্ষামন্ত্রীর পদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে গিয়েছিল ব্রাত্য বসুর কাছে। অর্থাৎ, যে সময়ে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এই অতিরিক্ত পদের অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ, সেই সময়ে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্রাত্য বসু। পার্থ ছিলেন শিল্পমন্ত্রী। ২০২২ সালের জুলাই মাসে এসএসসি মামলায় পার্থকে গ্রেফতার করা হয়।

কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দল?

কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে যে শিক্ষকেরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার রায়গঞ্জের জনসভা থেকে তিনি জানালেন, আদালতের সোমবারের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন তিনি। এই রায়কে ‘বেআইনি’ বলেও দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি, এই রায়ের প্রসঙ্গ টেনে নাম না করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও কটাক্ষ করলেন তৃণমূলনেত্রী। প্রশ্ন তুললেন, সোমবার আদালত যে রায় দিয়েছে, তা তিনি শনিবার কী ভাবে জেনেছিলেন? তবে কি তাঁরাই রায় লিখে দিয়েছেন? ‘বিজেপির বিচারালয়’ বলেও কটাক্ষ করেছেন তিনি।

সোমবার উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায় জনসভা করেন তৃণমূলনেত্রী মমতা। তৃণমূল প্রার্থী কৃষ্ণ কল্যাণীর হয়ে প্রচার করেন। সেই মঞ্চ থেকেই এসএসসি মামলা নিয়ে হাই কোর্টের রায় প্রসঙ্গে মুখ খোলেন তিনি। তুলে আনেন শুভেন্দুর বোমা ফাটানোর হুঁশিয়ারির প্রসঙ্গ। মমতা বলেন, ‘‘বোমা ফাটাবেন, বোমা? ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে যাবে, এমন বোমা! আমিও বলে রাখি, আমরাও লড়ে যাব। লড়াই করব। রায়কে চ্যালেঞ্জ করছি। উচ্চ আদালতে যাব। আশা রাখুন।’’ এখানেই থামেননি মমতা। নাম না করে শুভেন্দুকে আরও কটাক্ষ করেছেন তিনি। কী ভাবে শুভেন্দু সোমবারের রায়ের কথা শনিবার জেনেছিলেন, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ধিক্কার জানাই। কোর্ট কী রায় দেবে, তুই আগে জানলি কী ভাবে? সোমবার রায় দেবে, শনিবার জানলি কী ভাবে? যদি রায় নিজেরা লিখে না দিস? রায় নিজেরা তৈরি করে না দিস?’’ প্রসঙ্গত, শুভেন্দু গত শনিবার দাবি করেছিলেন, চলতি সপ্তাহে ‘বোমা’ পড়তে চলেছে! কোনও তারিখ না জানালেও বিরোধী দলনেতা দাবি করেন, আগামী সপ্তাহের ‘বোমা’য় ‘বেসামাল’ হয়ে যাবে তৃণমূল। সেই বোমার প্রসঙ্গ তুলেই মমতার পাল্টা খোঁচা, ‘‘বলছে বোমা ফাটাবে। বোমা কী? ২৬ হাজার লোকের চাকরি খেয়ে নিচ্ছে।’’

তবে মমতা এ-ও জানিয়েছেন, রায় যা-ই হোক চাকরিহারাদের পাশে রয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের চাকরি বাতিল করা হল, চিন্তা করবেন না, হতাশ হবেন না। কেউ জীবনের ঝুঁকি নেবেন না। আমরা পাশে আছি। যত দূর দরকার, লড়াই করব।’’ এর পর তিনি প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গও তুলেছেন। ইঙ্গিত দিলেন যে, প্রাক্তন বিচারপতির রায়ের নেপথ্যে আসলে রয়েছে বিজেপি। তিনি সোমবার জনসভায় বলেন, ‘‘এক জনকে দেখলেন না বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর রায় ছিল (চাকরি বাতিলের রায়)। দেখলেন না সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, নতুন ডিভিশন বেঞ্চ করে আলোচনা হোক। কাকে নিয়ে করবেন ডিভিশন বেঞ্চ? ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন।’’ মমতা জানিয়ে দেন, তিনি কোনও বিচারপতিকে নিয়ে বলছেন না। রায় নিয়ে বলছেন। সেই ‘অধিকার’ তাঁর রয়েছে। তবে বিচারালয়কে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি তিনি। বলেন, ‘‘এই এক হয়েছে বিজেপির বিচারালয়। না মন্দির, না মসজিদ। রাজনৈতিক বিচার। সেখানে অন্য লোক পিল করলে দেবে কিল। বিজেপি পিল (আবেদন) করলে বেল, আমরা পিল করলে জেল। এই তো অবস্থা। দীর্ঘ দিন ধরে চলছে। এটা বিচারপতিদের দোষ নয়। কেন্দ্রের দোষ। বিজেপি বসিয়েছে। যাতে তারা যা বলে, তা-ই করেন।’’

অন্য দিকে, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যকে সোমবারের এই নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমরা যে হেতু রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছি, তাই এ বিষয়ে এখন আমি কিছু বলব না।’’ হাই কোর্টের রায় সম্পর্কে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘এই রায়ের ফলে সকলের জন্যই অনিশ্চয়তা তৈরি হল। কিছু মানুষের অন্যায়ের ফলে সকলে তো ভুগতে পারে না।’’ সেই সঙ্গে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বোমা-হুঁশিয়ারি নিয়েও তিনি বলেন, ‘‘আদালতের রায় আগাম অনুমান করে যদি কেউ বলেন, বোমা পড়বে, তা হলে তার মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে।’’

আদালতের রায় সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ, ভুল বলে দাবি করলেন নিয়োগ-প্রাপকদের অন্যতম আইনজীবী তথা তৃণমূল নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এটি সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ রায়। কারও কারও ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল, ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তো অভিযোগ ছিল না। তা হলে কী করে এই রায় হয়?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে গেলে পাঁচ মিনিটে স্থগিতাদেশ হয়ে যাবে। আমি সব শিক্ষককে বলছি, নিশ্চিন্তে থাকুন। এই রায় সম্পূর্ণ ভুল রায়।’’

মমতা মন্ত্রিসভার গ্রেফতারি চান শুভেন্দু! সুকান্তের দাবি ইস্তফা

চাকরি বাতিল নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের রায়ের পরেই অতিরিক্ত শূন্যপদ (সুপারনিউমেরিক পোস্ট) তৈরি সংক্রান্ত রায় নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ শানালেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সোমবার বালুরঘাট লোকসভার কুমারগঞ্জে বরাহার ফুটবল মাঠে বিজেপির জনসভায় তিনি দাবি করেন, ২০২২ সালের ৫ মে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সকলকেই হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে হবে সিবিআইকে।

প্রসঙ্গত, নিয়োগ মামলার রায়ে কলকাতা হাই কোর্ট এসএসসিতে বেআইনি নিয়োগের মামলায় ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। অভিযোগ, অতিরিক্ত শূন্যপদ (সুপার নিউমেরিক পোস্ট) তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় নবান্ন। রাজ্য সরকারই সেই অনুমোদন দিয়েছিল। সোমবার কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়েছে, সিবিআই রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত সেই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করবে, যাঁরা অতিরিক্ত পদ তৈরির অনুমোদন দিয়েছিলেন এবং এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রয়োজনে ওই ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করা যাবে বলেও জানিয়েছে আদালত। এই প্রসঙ্গেই শুভেন্দু বলেন, ‘‘২০২২ সালের ৫ মে ক্যাবিনেটে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সবাইকে অবিলম্বে সিবিআই কাস্টডিতে নেওয়ার দাবি করি।’’ একই সঙ্গে ওই দিনের মন্ত্রিসভায় কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেই নথিও তাঁর কাছে রয়েছে বলে দাবি করেন শুভেন্দু।

এর পাশাপাশি নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মমতাকে আক্রমণ করেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা হাই কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। যাঁদের চাকরি চলে গিয়েছে তাঁদের নিয়ে আমার কোনও মন্তব্য নেই। এঁদের সামনে দোকান খুলে চাকরি বিক্রি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সাগরেদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ৩০ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীর যাঁরা সর্বনাশ করেছেন তাঁদের সর্বনাশ হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে।’’

অন্য দিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘এই রায় প্রমাণ করল তৃণমূল শিক্ষকতার মতো একটি সম্মানজনক পেশাকে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের মতো বাজারে বিক্রি করেছে। এই রায়ের ফলে ২৩ হাজার পরিবার অথৈ জলে পড়বে। এর দায় প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাই কাল বিলম্ব না করে উনি পদত্যাগ করুন।’’ বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমরা মনে করি যোগ্যদের চাকরি পাওয়া উচিত। তার ব্যবস্থা করতে হবে।’’ অন্য দিকে, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘চার সপ্তাহের মধ্যে যাঁদের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে, তাঁরা কোথা থেকে টাকা ফেরাবেন, আমি জানি না। কিন্তু যাঁরা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা একটা সুন্দর ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় নিজেদের সর্বস্ব তৃণমূল নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তৃণমূলকে সেই টাকা ফেরাতে হবে। যাঁরা তৃণমূল নেতাদের টাকা দিয়েছিলেন, তাঁরা থানায় এফআইআর করুন।’’

কী প্রতিক্রিয়া এসএসসির?

সোমবার হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বর রশিদির বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে তিনি খুশি নন বলে স্পষ্ট জানালেন, এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। তাঁর প্রশ্ন, পাঁচ হাজার জনের বিরুদ্ধে অবৈধ ভাবে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তার জন্য ২৬ হাজার জনের কেন চাকরি বাতিল হবে?

সেই সঙ্গে সিদ্ধার্থ জানান, আদালতের রায় তিনি এখনও পড়ে দেখেননি। রায়ের প্রতিলিপি হাতে এলে আইনজীবীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিদ্ধার্থের কথায়, ‘‘প্রায় ৩০০ পাতার রায়। প্রায় সাড়ে ৩০০টা মামলা। ভিতরে অনেক পয়েন্টস আছে। সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশ আছে কি না দেখতে হবে। সবটা না পড়ে কিছু বলা মুশকিল।’’

আরও পড়ুন
Advertisement