প্রতীকী চিত্র।
বারোয়ারি দুর্গাপূজার আদিভূমি এবং একচ্ছত্র ‘অধিপতি’ কলকাতা শহরকে দেখিয়ে দিল কল্যাণী। গ্রাম, মফস্সলের জনস্রোত পুজোয় সর্বদাই কলকাতামুখী। এ বছর যেন একই সঙ্গে চলল উলটপুরাণ। শিয়ালদহ থেকে কল্যাণীগামী ট্রেনে থিকথিক করছে ভিড়। গভীর রাতে বা ভোরবেলায় বাড়ি ফেরার ভিড় নয় একেবারেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ ভিড় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার। এতটাই ভিড় যে, প্রায় বেনজির ঘটনা ঘটাতে হয়েছে রেলকে। জনস্রোতে লাগাম দিতে, স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত কোনও ট্রেন দাঁড় করানো হয়নি কল্যাণী ঘোষপাড়া স্টেশনে। যে পুজো নিয়ে এত উন্মাদনা, তা ক্লাব লুমিনাসের। কলকাতার অধিকাংশ পুজোর থেকেই তার বয়স কম। কিন্তু কলকাতার অনেক বড় পুজোকেও ভিড়ের লড়াইয়ে টেক্কা মেরে দিয়েছে, বলছেন দুই শহরেই ঠাকুর দেখতে যাওয়া অনেকেই।
কল্যাণীর আইটিআই মোড়ের কাছে ক্লাব লুমিনাসের পুজো এ বছর ৩১ বছরে পা দিয়েছে। চিনের বিলাসবহুল হোটেল ‘গ্র্যান্ড লিসবোয়া’র আদলে তৈরি হয়েছে তাদের মণ্ডপ। এই পুজো দেখতেই কাতারে কাতারে মানুষ কল্যাণীমুখী। কলকাতা থেকে কল্যাণী যাওয়ার সহজ উপায় লোকাল ট্রেন। মূলত দুই ধরনের ট্রেন কল্যাণী যায়। শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট, শান্তিপুর, গেদে, কিংবা কৃষ্ণনগরের মতো যে কোনও লোকাল ট্রেনে চাপলেই কল্যাণী স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়। এ ছাড়া রয়েছে কল্যাণী সীমান্ত লোকাল, যা কল্যাণীর মূল স্টেশন থেকে পাশের লাইনে ঘুরে আরও তিনটি স্টেশনে থামে। সীমান্ত লোকালে কল্যাণীর পরেই রয়েছে কল্যাণী ঘোষপাড়া, কল্যাণী শিল্পাঞ্চল এবং সব শেষে কল্যাণী সীমান্ত। লুমিনাস ক্লাবের পুজোটি কল্যাণী ঘোষপাড়া স্টেশনের কাছে।
পুজো উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এ বছর চতুর্থীর দিন থেকেই তাঁদের মণ্ডপ ভাসছে জনজোয়ারে। কলকাতা এবং আশপাশের এলাকা থেকে বহু মানুষ কল্যাণী সীমান্ত লোকালে চেপে ঘোষপাড়া স্টেশনে নামছেন এবং মণ্ডপে পৌঁছচ্ছেন। ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলেন ক্লাবের সদস্যেরা। সেই কারণে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে রেলের কাছে লিখিত ভাবে ওই বিশেষ স্টেশনটিতে পুজোর ক’দিন ট্রেন বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী, ষষ্ঠী থেকে দশমী পুজোর মূল পাঁচ দিন কল্যাণী সীমান্ত লোকাল ঘোষপাড়া স্টেশনে থামছে না। পূর্বরেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কল্যাণীর একটি পুজোয় খুব ভিড় হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের কাছে ওই স্টেশনে ট্রেন বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছিল। দশমী পর্যন্ত ট্রেন রাখা হয়েছে।’’ ঘোষপাড়া স্টেশনে ট্রেন বন্ধ করেও অবশ্য ভিড়কে দমিয়ে রাখা যায়নি। মানুষ কল্যাণী স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে পায়ে হেঁটেই আইটিআই মোড় পর্যন্ত যাচ্ছেন এবং পুজো দেখে আসছেন।
এর আগে ২০২১ সালে শ্রীভূমির মণ্ডপ দেখতে জনজোয়ার এসেছিল বিধাননগর স্টেশনে। ওই স্টেশনটিতেও বাধ্য হয়ে সাময়িক ভাবে কয়েক ঘণ্টা করে ট্রেন বন্ধ করেছিল রেল। তবে কল্যাণীর মতো একটি স্টেশন টানা পাঁচ দিনের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া নিসঃন্দেহে বেনজির।
লুমিনাস ক্লাবের পুজো উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, চতুর্থী থেকে নবমী পর্যন্ত ১০ লক্ষের বেশি মানুষ তাঁদের পুজো দেখতে এসেছেন। কলকাতার যে কোনও বড় পুজোকে টেক্কা দিতে সক্ষম কল্যাণীর এই ‘গ্র্যান্ড লিসবোয়া’। ক্লাবের অন্যতম সদস্য অমিত বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুধু নদিয়া জেলা নয়, গোটা রাজ্যের নজর কাড়া আমাদের লক্ষ্য। জেলার পুজোও যে কলকাতার ভিড় টানতে পারে, সেই নজির আমরা তৈরি করেছি।’’
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে ক্লাব লুমিনাসের মণ্ডপ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। প্রতি দিন ৮০ জন শ্রমিক দিনরাত এক করে খেটেছেন। মণ্ডপ তৈরির মূল উপকরণ বাঁশ, কাঠ, প্লাইউড, কাচ এবং ফাইবার। লুমিনাস ক্লাবের প্রতিমাসজ্জাও আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে। ৫০ কিলো সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হয়েছে মাকে। বেঙ্গালুরুর নামী সংস্থা পেয়েছে এই পুজোর লেজ়ার শো-এর দায়িত্ব। আয়োজনের মোট খরচ ৫৫ লক্ষ টাকা।
নবমীর রাতে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার থেকে কল্যাণী গিয়েছিলেন এক শিক্ষক দম্পতি। তাঁদের কথায়, ‘‘এটি এখন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা পুজো। সপ্তমী, অষ্টমী কলকাতায় ঠাকুর দেখে নবমীতে আমরা কল্যাণী এসেছি। এই ধরনের পুজো যদি কলকাতায় হত, ভিন্ রাজ্য থেকেও মানুষ তা দেখতে আসতেন।’’
কল্যাণীর পুজোয় এই ভিড় অবশ্য এ বছরই নয়। গত বছরেও পুজোমণ্ডপের কারুকার্যে তাক লাগিয়েছিল লুমিনাস ক্লাব। মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারের আদলে তাঁদের মণ্ডপসজ্জা দেখতে সে বারও বহু মানুষ কলকাতা থেকে কল্যাণী ছুটে গিয়েছিলেন। অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে, শর্ট সার্কিট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল মণ্ডপে। বন্ধ করে দিতে হয়েছিল মণ্ডপের বিশেষ আলোর প্রদর্শনী। সেই থেকেই কল্যাণীর উত্থানের শুরু। এ বছর কলকাতার ভিড়ের একক গরিমায় যেন সজোরে ধাক্কা মেরে ভাগ বসিয়ে দিয়েছে নদিয়ার শহর। তা-ও একটা মাত্র পুজো দিয়েই। কলকাতার ভিড় অবশ্য কমেনি। বরং বেড়েইছে। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, টালা প্রত্যয়, শ্রীভূমি, সুরুচি সঙ্ঘ থেকে বরিষা ক্লাব— এ বারও জনসমাগম চোখে পড়ার মতো। তবে সেই জনতাকে উল্টোপথে কল্যাণীতেও টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। কঠিন কাজটা করে ফেলেছে ক্লাব লুমিনাস। ‘করে ফেলেছি’ই বলছেন ক্লাবের কর্তারা। কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করছেন, এই যে স্রোতের উল্টোদিকেও নতুন স্রোত তৈরি হয়ে গেল, এ স্রোত থামবে না। থামতে তাঁরা দেবেন না।