টাকার বিনিময়ে অনলাইন গেমের প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি পাচ্ছে কিশোরদের। — প্রতীকী চিত্র।
অনলাইনে ‘পেড গেম’-এর মাধ্যমে সহজে অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে পাচ্ছে পড়ুয়ারা? কাঁচা টাকা রোজগারের হাতছানিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে আসক্তি? স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে এই প্রবণতায় উদ্বিগ্ন অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষকেরাও। আজকাল ঘরে ঘরে স্কুল পড়ুয়াদের হাতে স্মার্ট ফোন। তার সঙ্গে ইন্টারনেটের দৌলতে অনলাইন গেমের ভাণ্ডার অফুরান। এর মধ্যে কিছু কিছু অনলাইন গেম রয়েছে যেগুলিতে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে খেলতে হয়। এগুলিকে বলা হয় ‘পেড গেম’। লুডো, তাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনলাইন ‘পেড গেম’ রয়েছে। জিতলেই মোটা টাকার পুরস্কারমূল্য সরাসরি প্রবেশ করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। মনোবিদদের মতে, এই কাঁচা টাকার প্রলোভনেই পা দিচ্ছে পড়ুয়ারা।
কল্যাণী থেকে করিমপুর, রানাঘাট থেকে কৃষ্ণনগর— নদিয়ার প্রায় সর্বত্রই পড়ুয়াদের মধ্যে এই পেড গেমের প্রতি কমবেশি আসক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেশি পছন্দের লুডো, তাস, লটারির মতো পেড গেমগুলি। অভিভাবকেরা বকাবকি করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সম্প্রতি শান্তিপুরে বাবার কাছে বকুনি খেয়ে আত্মহত্যাও করেছে এক কিশোর। ‘পেড গেম’ খেলার জন্য টাকা চেয়েছিল সে। দিতে রাজি না হওয়ায় এবং বকুনি দেওয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় কিশোর। শান্তিপুরের এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন অন্য অভিভাবকেরাও। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা সুব্রত মজুমদারকেও সন্তানের এমন ‘আবদার’-এর সম্মুখীন হতে হয়। দৃশ্যত উদ্বিগ্ন সুব্রত বলেন, “দু’হাজার টাকা না দেওয়ায় তিন দিন বাড়িতে খায়নি। বাইরে কাজের চাপ বাড়ি। ফিরে এই অশান্তি মাথায় নেওয়া যাচ্ছে না। দাবি মানা ছাড়া আর কি উপায় আছে বলুন তো?”
তবে অভিভাবকদের এই উদ্বেগ পড়ুয়াদের কতটা ভাবাচ্ছে, সেটাও চিন্তার বিষয়। তাদের বেশিরভাগই এই সবের বিশেষ তোয়াক্কা করে না। বরং কয়েক ঘণ্টায় কয়েকশো টাকা রোজগারের প্রলোভন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে তাদের। নদিয়ার চাপড়া হাই স্কুলের একাদশ শ্রেণির এক পড়ুয়ার কথায়, “লুডো জাতীয় অনলাইন গেম খেলে গত এক সপ্তাহে রোজগার হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। পরিবারের লোকজন আপত্তি করলেও এই টাকা কে দেবে?” পড়ুয়াদের মধ্যে অনলাইনে ‘পেড গেম’-এর প্রতি আসক্তিতে উদ্বিগ্ন নাজিরপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পশুপতি সরকারও। এই আসক্তি চরিতার্থ করার জন্য টাকার উৎস খুঁজতে পড়ুয়ারা অসাধু পথের দিকেও এগোতে পারে বলে আশঙ্কা পশুপতির। এই সমস্যা দূর প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ চান তিনি।
তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল অনলাইন ‘পেড গেম’গুলির বেশিরভাগই বৈধ। ফলে এগুলির বিরুদ্ধে আইনত বিশেষ কোনও পদক্ষেপ করা যায় না। যদিও কিছু কিছু অবৈধ পেড গেমও রয়েছে। সেগুলির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করা যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তেহট্ট মহকুমা পুলিশ আধিকারিক শুভতোষ সরকারের কথায়, “এই ভাবে পারিবারিক বিষয়ের মধ্যে তো পুলিশ অযাচিত ভাবে প্রবেশ করতে পারে না। তবে অবৈধ অনলাইন লটারির ক্ষেত্রে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে।” কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তমকুমার ঘোষও জানিয়েছেন, সাইবার অপরাধ এবং মোবাইল প্রটোকল নিয়ে তরুণদের সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মশালা চলছে। টাকার বিনিময়ে অনলাইন গেমের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। সেগুলির বিষয়েও সচেতনতা শিবির চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে, মাদকের নেশায় স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশ প্রভাবিত হয় অনলাইন গেমের আসক্তিও সেই অংশকে প্রভাবিত করছে। চিকিৎসা করাতে আসা বেশিরভাগ রোগীর বয়স ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। সহজলভ্য স্মার্টফোন ছেলেমেয়েদের এই ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। মোবাইল গেমিংয়ে আসক্তির প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আকাশদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “শহর অঞ্চল ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাতেও এই আসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। যে দ্রুত হারে এই আসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে অবিলম্বে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পড়বে।”