Death

Death: লঞ্চ ফিরিয়েও তোলা গেল না কোলছুট মেয়ে

প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশ্ন উঠছে লঞ্চের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। সেটির বসার জায়গার চারপাশ লোহার পাইপ দিয়ে ঘেরা।

Advertisement
সম্রাট চন্দ ও কেদারনাথ ভট্টাচার্য
শান্তিপুর ও কালনা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২১ ০৭:১৮
তৃষা।

তৃষা। নিজস্ব চিত্র।

বাড়ি জুড়ে এখনও ছড়ানো নানা খেলনা। বাড়ির কেউই এখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেননি।

আগের সন্ধ্যাতেই মায়ের কোল থেকে ভরা গঙ্গায় পড়ে ভেসে গিয়েছে মাত্র চোদ্দো মাসের তৃষা। শান্তিপুরে বাগআঁচড়া পঞ্চায়েতের বালিয়াডাঙার ঘোষবাড়ি ঘিরে বৃহস্পতিবার দুপুরেও ছড়ানো শোকের ছায়া।

Advertisement

বাড়ির উঠোনে ইতস্তত জড়ো পড়শিরা। ছোট সিঁড়ি পার করে টানা বারান্দায় নির্বাক বসে বাসিন্দারা। নীরবতা ভেঙে তৃষার পিসি প্রতিমা ঘোষ বলেন, “কয়েক দিন আগেই ভাইপো-ভাইঝিদের পুজোর জামা দিয়ে গেলাম। মেয়েটার জামা পড়েই রইল।” বোনকে থামিয়ে তৃষার বাবা অমিত ডুকরে ওঠেন, “ওই জামাটা এক দিন পড়েছিল মেয়ে। কিন্তু আমার দেওয়া পুজোর জামা না নিয়েই তো চলে গেল!” নদিয়ারই কৃষ্ণনগর সেনপাড়ার মেয়ে তাপসীর সঙ্গে সাত বছরের সংসার তাঁতশিল্পে যুক্ত অমিতের। এক ছেলে, এক মেয়ে — চার বছরের অর্পণ আর চোদ্দো মাসের তৃষা। কিছু দিন আগে দুই ছেলেমেয়েরই ঠান্ডা লাগে। স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে দেখিয়ে তারা কিছুটা সুস্থও হয়। অমিত বলেন, “এক সময়ে ছেলেকে কালনার এক শিশু চিকিৎসকের কাছে দেখাতাম। তাঁর কাছেই নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমার স্ত্রী।”

বুধবার দুপুরে নৃসিংহপুর ঘাটে মোটরবাইক রেখে ফেরিতে তাঁরা চলে যান ও পারে, পূর্ব বর্ধমানের কালনায়। ডাক্তার দেখিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এক দোকান থেকে মিষ্টি কিনে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ তাঁরা কালনা ঘাট থেকে লঞ্চে ওঠেন। ওই লঞ্চে থাকা কালনার অটো চালক সাগর ধর বলেন, ‘‘লঞ্চ মাঝনদীতে পৌঁছনোর পরে ঘটনাটি ঘটে। মেয়ে নিয়ে লঞ্চের গেটের কাছাকাছি ছিলেন মহিলা। উল্টো দিকে ছিলেন তাঁর স্বামী। হঠাৎ জলে কিছু পড়ার শব্দ আসে।’’

অমিতের কথায়, “আমি ছেলেকে নিয়ে উল্টো দিকে বসেছিলাম। লঞ্চ ছাড়ার কিছুপরেই মাঝি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কে কী ফেলল?’ উঠে গিয়ে দেখি, তাপসীর কোলে মেয়ে নেই।” সাগর বলেন, “লোকজন জড়ো হয়ে যায়। মহিলা জানান, তাঁর কোল থেকে বাচ্চা জলে পড়ে গিয়েছে।”

ব্যাপার বুঝে চালক লঞ্চ কিছুটা পিছিয়ে আনেন। মোবাইলের আলো এবং লঞ্চে থাকা সার্চলাইট নিয়ে শুরু হয় খোঁজ। কিন্তু ভরা ভাগীরথীতে শিশুটির সন্ধান মেলেনি। লঞ্চের কর্মী তাপস বর্মণ বলেন, ‘‘লঞ্চ ঘুরিয়ে আনা হলেও কিছু দেখা যায়নি। নদীতে তখন তীব্র স্রোত ছিল।’’ লঞ্চের এ মাথা-ও মাথা খানিক ছোটাছুটির পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন অমিত।

তাপসী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আগেই। কোনও রকমে তিনি জানান, আচমকা মাথা ঘুরে যাওয়ায় তাঁর হাত আলগা হয়ে মেয়ে পড়ে যায়। ছেলে নিয়ে আপাতত তিনি কৃষ্ণনগরে বাপের বাড়িতে রয়েছেন। কথা বলার অবস্থায় নেই। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই শোকে অভিভূত হয়ে গিয়েছেন। লঞ্চের কর্মী শ্রীনাথ মাহাতো বলেন, ‘‘ওইটুকু শিশু জলে তলিয়ে গিয়েছে ভেবে বুধবার সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’’

অমিতের দাদা আশিস ঘোষ বলেন, “ঘাটে অনেকেই উত্তেজিত হয়ে নানা রকম দাবি করতে থাকে। বাচ্চা কী করে পড়ল সেই প্রশ্ন তুলে মারতেও উদ্যত হয়। ওদের সংসারে কিন্তু অশান্তি ছিল না। আমাদের ভাইবোনদের সন্তানদের মধ্যে তৃষাই একমাত্র মেয়ে। তাই আমাদের সবার খুব আদরের।”

প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশ্ন উঠছে লঞ্চের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। সেটির বসার জায়গার চারপাশ লোহার পাইপ দিয়ে ঘেরা। লঞ্চের কর্মীদের দাবি, সামনে দু’টি দরজা দিয়ে যাত্রীরা ওঠার পরেই তা লোহার শিকল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। জলে কারও পড়ে যাওয়া কঠিন। কালনা খেয়াঘাট কর্তৃপক্ষের তরফে জয়গোপাল ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘লঞ্চ চলাকালীন শিশুরা যদি খেলা করে, সে ক্ষেত্রে পাইপ গলে বাইরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই মাইকে বারবার সতর্ক করা হয়।’’

লঞ্চের চার দিক কেন তার দিয়ে ঘেরা থাকে না? তাঁর বক্তব্য, ‘‘যদি নদীতে বড় বিপদ ঘটে যায়, যাত্রীরা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। তাই নিরাপত্তার স্বার্থেই তা করা হয় না।’’

আরও পড়ুন
Advertisement