রাধা কালাচাঁদ জীউ বাড়ি। শান্তিপুরে। ছবি: প্রণব দেবনাথ
মুম্বই থেকে টেলিফোনে আকুতিভরা কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, “যদি কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এটিকে অধিগ্রহণ করেন কিংবা যদি কোনও বৈষ্ণব সংগঠন এর পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তা হলে খুব ভাল হয়। কেননা, আমাদের পক্ষে আর টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
চিত্র ১) আরব সাগরের পাড়ে বসে এই আক্ষেপ যাঁর, তিনি রাধাসুন্দর গোস্বামী। শান্তিপুরের ঐতিহ্যবাহী ‘ওড়িয়া গোস্বামী বাড়ির’ মদনমোহন জিউর অন্যতম সেবায়েত। কয়েকশো বছরের প্রাচীন ওই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে। উত্তরসূরিরা বেশির ভাগই মারা গিয়েছেন। জীবিতদের প্রায় সকলেই পেশার প্রয়োজনে বিদেশ বিভুঁয়ে। ফলে, বিগ্রহের সেবাপুজো না চলার মতো। এই অবস্থায় মন্দির পরিচালনার ভবিষ্যৎ ভেবে প্রবাসে অস্থির হয়ে উঠেছেন গোস্বামী সন্তান।
চিত্র ২) হাতের তাঁত থামিয়ে শান্তিপুর ফটক পাড়ায় বসে আক্ষেপ করছিলেন প্রবীণ রাজীব সেন। “সরকারি, বেসরকারি কোনও একটু সাহায্য যদি পেতাম তা হলে হয়তো মন্দিরটা আমরা ঠিকমতো চালাতে পারতাম। তাঁত বুনে কি মন্দির চালানো সম্ভব?”
রাজীব আসলে শান্তিপুরের রাধা কালাচাঁদ জীউ বিগ্রহবাড়ির অন্যতম সেবায়েত। মোট ছ’জন শরিক এখন পালা করে মন্দির পরিচালনা, বিগ্রহসেবার কাজ চালান। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁত বুনে সংসার চালান। ফলে, তাঁদের পক্ষে বারো মাস তিরিশ দিনের বিগ্রহের সেবা এবং নানা রকম পালপার্বণ সামলাতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার দশা। মন্দিরের অবস্থা তথৈবচ।
চিত্র ৩) “প্রায় ষাট বছর আগে মৃত একজন মানুষ দু’মাস আগে বিগ্রহবাড়ির জমি কিনেছেন! ভাবতে পারেন কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা?” উত্তেজনায় কথা প্রায় আটকে যাচ্ছিল গোবিন্দগোপাল গোস্বামীর। যিনি নিজে অদ্বৈতাচার্যের উত্তরসূরি। শান্তিপুরের বাঁশবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির সন্তান। শান্তিপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শ্যামসুন্দর জিউ মন্দিরের জমি এ ভাবে হাতবদলের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছেন সেবায়েতরা।
এমন উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ। শান্তিপুরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী অসংখ্য মন্দির। স্থানীয় ভাবে যা বিগ্রহবাড়ি নামে পরিচিত। কয়েকশো বছরের ওই সব বিগ্রহবাড়ির গায়ে স্বাভাবিক নিয়মেই পড়েছে সময়ের শ্যাওলা। বহু প্রাচীন ওই সব মন্দিরের অনেকগুলির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নপ্রায় দশা। কোনওটির জমি বেদখল হয়ে গিয়েছে। কোনও বিগ্রহবাড়ির আশি শতাংশই কালগর্ভে চলে গিয়েছে।
বৈষ্ণব জগতে অদ্বৈতাচার্যের খ্যাতি গৌর আনা গোঁসাই বলে। ভক্তদের বিশ্বাস, তাঁরই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিষ্ণুর চৈতন্যরূপে আবির্ভাব নবদ্বীপে। তাঁর সাধনক্ষেত্র শান্তিপুর বৈষ্ণবসমাজের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান। যদিও অদ্বৈতাচার্য আদতে শ্রীহট্টের মানুষ। ৮৪০ বঙ্গাব্দে তাঁর জন্ম বাংলাদেশের লাউর পরগনায়। পিতা কুবের মিশ্র ছিলেন নবগ্রামের রাজা দিব্যসিংহের সভাপণ্ডিত। কিন্তু সেখান থেকে কী ভাবে, কবে শান্তিপুরের এলেন, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু একটি বিষয়ে পণ্ডিতেরা একমত— শান্তিপুর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে মূল ভুমিকা ছিল অদ্বৈতাচার্যের।
বারো বছর বয়স থেকে কমলাক্ষের সুদীর্ঘ জীবন, সাধনা সবই শান্তিপুরে। কথিত আছে, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য ১২৫ বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর পুত্র-পৌত্র উত্তরসূরিদের হাত ধরে শান্তিপুরে বৈষ্ণবধর্ম এবং শাস্ত্রচর্চার প্রসার হয়। এই গোস্বামী পরিবারগুলি অদ্বৈতাচার্যের বংশের শাখাপ্রশাখা। তাঁর ছয় পুত্রের কনিষ্ঠ বলরাম মিশ্রের ষষ্ঠ পুত্র ছিলেন মথুরেশ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক। তাঁর হাত ধরে শান্তিপুরে শাস্ত্রচর্চা নতুন ভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। তাঁর তিন পুত্র। রাঘবেন্দ্র, ঘনশ্যাম এবং রামেশ্বর। অদ্বৈতাচার্যের জীবিত কালেই নিজ পুত্রদের পৃথক করে দিয়েছিলেন মথুরেশ। শান্তিপুরের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা হয়। সেই থেকেই শান্তিপুরের গোস্বামী পরিবার তথা বিগ্রহবাড়ি সমূহের সৃষ্টি। যদিও সেই সব বিগ্রহবাড়িই আদতে অদ্বৈতাচার্যের বংশধরের নয়।
এই মুহূর্তে শান্তিপুরে মোট ৩৯টি বিগ্রহবাড়ি আছে, যার মধ্যে অন্তত দশটির অবস্থা অতীব সঙ্কটজনক।